ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ক্রমেই বন্ধ হচ্ছে খামার

রাজশাহী অঞ্চলে ঝুঁকির মুখে পোল্ট্রি শিল্প

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬

রাজশাহী অঞ্চলে ঝুঁকির মুখে পোল্ট্রি শিল্প

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ ব্যাপক সম্ভাবনাময় খাত হলেও আবহাওয়াজনিত কারণে রাজশাহী অঞ্চলে ক্রমেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক মুরগির খামার। এজন্য খামারিরা দুষছেন পরিবর্তিত আবহাওয়াকেই। তাদের ভাষ্য, রাজশাহী অঞ্চলে গরমকালে তীব্র গরম ও শীতকালে তীব্র শীতের কারণে তারা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন খামার। এছাড়া পরিবেশের কারণেও ঝুঁকিতে রয়েছে এ অঞ্চলের পোল্ট্রি শিল্প। এ অবস্থায় অব্যাহত লোকসানে গত ছয় মাসে বন্ধ হয়ে গেছে দুই হাজারের বেশি খামার। আর গত পাঁচ বছরে বন্ধ হয়েছে ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ১০ হাজার খামার। রাশি রাশি স্বপ্ন নিয়ে এসব খামার গড়ে তোলা হলেও বেশিদিন টেকাতে পারছেন না এ অঞ্চলের খামারিরা। খরায় অতিরিক্ত গরম আর শীতে মাত্রাতিরিক্ত শীতের কারণে বছরের ছয় মাস চরম পরিস্থিতি দারুণভাবে ভোগাচ্ছে এ অঞ্চলের পোল্ট্রি খামারিদের। শীত ও গরম এ দুই মৌসুমে নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মুরগি। বিশেষ করে ব্রয়লার মুরগি আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। আর লেয়ারের কমে যাচ্ছে ডিম। প্রতি বছরই লোকসান গুনতে হচ্ছে খামারিদের। এতে বাধ্য হয়ে অনেকেই বন্ধ করে দিচ্ছেন খামার। রাজশাহী নগরীর ছোট বনগ্রাম এলাকার বাসিন্দা মুনতাসীর রহমান শুভ। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষে জড়িয়েছিলেন পোল্ট্রি খামারে। ১৯৯৭ সালে বাড়ির পেছনে এক খ- জমিতে টিনের চালা আর বাঁশের বেড়া ঘিরে তৈরি করেন স্বপ্নের খামার। ভালই চলছিল তার খামার। পরের পনেরো বছর টানা লাভ করেছেন তিনি। কিন্তু শেষ কয়েক বছরের লোকসানে খেই হারিয়ে ফেলেন। ঋণে দাঁড়ানো ব্যবসা হয়ে পড়ে টালমাটাল। খামার গুটিয়ে নিয়ে এখন বেকার স্বপ্নবাজ এ যুবক। তার অভিজ্ঞতায়, শীতকালে প্রচ- ঠা-া এবং খরায় প্রচ- গরম পড়ছে। এছাড়া শীতের রোগ হচ্ছে গরমে, গরমের রোগ ছড়াচ্ছে শীতকালে। রোগে মুরগি সাবাড় হচ্ছে। যেগুলো টেকানো যাচ্ছে কোনমতে সেগুলো ডিম দিচ্ছে না। থমকে যাচ্ছে বৃদ্ধি। ওষুধ কিনতে কিনতে পুঁজি শেষ। দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা দিয়ে ফল হচ্ছে না। জেলার মোহনপুর উপজেলার কেশরহাট এলাকার খামারি মশিউর রহমান, তিনি প্রায় পাঁচ বছর ধরে মুরগির খামার করছেন। শুরুর দিকে ভাল লাভ হলেও এখন উল্টোচিত্র। বিশেষ করে মার্চ থেকে জুন এবং ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই সাত মাস মুরগি সুস্থ রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। ঠা-া থেকে গরম আবার গরম থেকে ঠা-া- এই হচ্ছে আবহাওয়া। একটু বেশি গরম বা ঠা-া পেলেও অসুখে মারা যাচ্ছে মুরগি। আর কী অসুখ হচ্ছে তাও ঠিকমতো বলতে পারছেন না চিকিৎসকরা। বাধ্য হয়ে তাই খামার গুটিয়ে নিচ্ছেন অনেকেই। রাজশাহী অঞ্চলের খামারিরা জানান, ২০০২ সালের পর এ অঞ্চলে লাভজনক হওয়ায় মুরগি খামার শুরু করেন অনেকে। শুরু থেকেই আবহাওয়ার প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে টিকিয়ে রাখা হয় খামার। তবে এখন দারুণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তীব্র ঠা-া-গরমে রোগে আক্রান্ত হয়ে মুরগি মারা যাচ্ছে। কোনভাবেই টেকানো যাচ্ছে না। ফলে এই সময়ে ব্যাপক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে মুরগির খামার। পোল্ট্রি গবেষক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যানিমেল হাজবেন্ডারি এ্যান্ড ভেটেরিনারি সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ সারোয়ার জাহান জানান, খামারে পালন করা মুরগির স্বাভাবিক বৃদ্ধি বজায় থাকে ১৫ থেকে ২২ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। এর বেশি বা কম হলেই বিপদ। কিন্তু রাজশাহীতে গরমকালে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায় আর শীতে তাপমাত্রা নেমে যায় ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। এ কারণে হিটস্ট্রোক ও কোল্ড ইরজুরিতে আক্রান্ত হয় মুরগি। দেখা দেয় রোগবালাই। জীবিত মুরগি অতিরিক্ত গরম ও শীতের ধকল সহ্য করতে না পেরে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। নানান ধরনের রোগ দেখা দেয়। তখন স্বাভাবিক ডিম দেয়া বন্ধ করে দেয়। এ সময় চিকিৎসা ব্যয়ও বেড়ে যায়। লোকসানে পড়ে খামারিরা বাধ্য হন খামার বন্ধে। বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ড. জালাল উদ্দিন সরদার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে রাজশাহী অঞ্চলে মুরগিতে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছেÑ এ্যাভিয়েন, ব্রঙ্কাইটিস, মাইক্রোপ্লাজমা প্রভৃতি। খামারিরা সচেতন না হলে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। পাশাপাশি নতুন নতুন রোগের প্রতিষেধকও উদ্ভাবন করা জরুরী। এদিকে পোল্ট্রি শিল্পের নানান সমস্যার কথা স্বীকার করে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের বিভাগীয় উপ-পরিচালক ডাঃ রেজাউল ইসলাম বলেন, আবহাওয়ার হেরফের হওয়ায় এ্যাভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা বা সোয়ায়েন ফ্লুর মতো রোগ আমাদের দেশে এসে গেছে, যা আগে ছিল না। নতুন নতুন রোগ দেখা দিচ্ছে, সমস্যা বাড়ছে। এ নিয়ে সরকারের তরফ থেকে এখনও ওষুধ বা প্রতিষেধক নেই। খামারিরা নিজ উদ্যোগে এসব এনে প্রয়োগ করছেন। তবে খামারিদের পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করছে প্রাণিসম্পদ দফতর। রাজশাহী বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দফতরের হিসাবমতে, বর্তমানে রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে মুরগি খামার রয়েছে ১৫ হাজার ৩২১টি। এর মধ্যে লেয়ার খামার তিন হাজার ৩৬০ ও ব্রয়লার খামার ১১ হাজার ৯৬১টি। চলতি বছরের গত জুন মাসেও এ অঞ্চলে চার হাজার ১৮৯টি লেয়ার ও ১৩ হাজার ২৪৫টি ব্রয়লার খামার ছিল। এক মাসে ৮২৯টি লেয়ার এবং এক হাজার ২৮৪টি ব্রয়লার খামার বন্ধ হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে লোকসানে পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে এসব খামার।
×