ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গোপালগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়া এখন রোগ শোকে ক্লান্ত

ভাটিয়াপাড়া শত্রুমুক্ত হওয়ার আগে রেল লাইন উপড়ে ফেলি

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬

ভাটিয়াপাড়া শত্রুমুক্ত হওয়ার আগে রেল লাইন উপড়ে ফেলি

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ‘দেশে তখন তুমুল যুদ্ধ। দেশমাতাকে মুক্ত করতে ট্রেনিং নিতে ভারতে যাই। ভারতের কদমহাটি ও দমদম ক্যাম্পে আক্তার উদ্দিন মোক্তার কমান্ডারের নেতৃত্বে আমরা ট্রেনিং নিই। সেখানে সহযোগী কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন আমজাদ চেয়ারম্যান। ট্রেনিং চলাকালীন ক্যাম্পে রান্না-বান্নার দায়িত্ব পড়ে আমার কাঁধে। ১৪৭ জনের খাবার রান্না করতে হতো প্রতিদিন। একদিন বোয়াল মাছ কাটতে গিয়ে হাতের বুড়ো আঙ্গুল হারাই’- মহান বিজয়ের মাসে জনকণ্ঠের কাছে যুদ্ধদিনের স্মৃতি এভাবেই তুলে ধরেন গোপালগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়া শেখ। আঙ্গুল হারালেও থেমে থাকেননি তিনি। দেশে ফিরে এসে অংশ নেন সম্মুখযুদ্ধে। পাকবাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে করিমপুর ব্রিজ যুদ্ধে অংশ নিয়ে উপড়ে দেন রেললাইন। তাদের অভিযানেই পাকিস্তানী হানাদারমুক্ত হয় ভাটিয়াপাড়া। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার নড়াইল গ্রামের এই মুক্তিযোদ্ধা এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। হাঁটতে হয় অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে। দুইবার স্ট্রোক করায় তিনি এখন অনেকটাই ঘরবন্দী। শেষ বয়সে এসে চালাতে পারছেন না নিজের চিকিৎসা খরচও। সরকারীভাবে মাসিক ভাতা ১০ হাজার টাকা হলেও বর্তমানে তিনি পাচ্ছেন মাত্র ৪ হাজার ৯শ’ টাকা। এককালীন ২ লাখ টাকা ঋণ নেয়ায় তার প্রতিমাসের ভাতা থেকে বাকি টাকা কেটে রাখা হচ্ছে। দিনপ্রতি ওষুধের পেছনে এই মুক্তিযোদ্ধার ৩শ’ টাকা খরচ হওয়ায় তিনি এখন নিরুপায়। চিকিৎসা পেতে দ্বারস্থ হচ্ছেন অন্যের কাছে, জানাচ্ছেন আকুতি-মিনতিও। লাল মিয়ার ভাষ্য- ‘এই টাকা দিয়ে আমার ওষুধ খাবারই চলে না। তবু চালিয়ে নিচ্ছি। যুদ্ধে বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুল হারিয়েছি। সেই হিসেবে পঙ্গু ভাতা পাওয়ার কথা। কিন্তু পাচ্ছি না।’ যুদ্ধ হয়েছে বহু বছর। যে লড়াকু সৈনিকদের হাত ধরে রচিত হয়েছে বিজয়গাথা; তাদের অনেকেই এখন জীবনের শেষপ্রান্তে। তেমনই এক বীর মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়া। এখন স্মৃতিও ঠিকঠাক মনে করতে পারেন না। তবে স্মৃতির পাতা থেকে বলতে পারেন কিছুটা। একান্ত আলাপে জনকণ্ঠকে শোনালেন তাই। যুদ্ধে ঠিক কবে অংশ নিলেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ট্রেনিং নেয়ার জন্য ভারতের উদ্দেশে রওনা দিই। কদমহাটি দমদম এলাকার ক্যাম্পে ট্রেনিং নিই। দেশে এসে দৌলতপুরে কিছুদিন থাকি। এরপর খালিশপুরে ৪-৫ দিন অবস্থান করি। ওখানে এসে আমরা বিহারীদের আর্মস উদ্ধার করি। পরে গোপালগঞ্জের দিকে রওনা হই। সাধুহাটি নড়াইল এসে ফাইটিং করি। পাকবাহিনীর উপস্থিতিতে রাজাকাররা সাধারণ মানুষের ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছিল। সেখানে ১ রাত যুদ্ধ শেষ রাজকাররা আত্মসমর্পণ করে। ১৬ তারিখ দেশ স্বাধীন হলেও ভাটিয়াপাড়া বাকি থাকে। সাধুহাটি থেকে ফিরে এসে ১৬, ১৭ ও ১৯ ডিসেম্বর একত্রিত হয়ে আমরা ভাটিয়াপাড়ায় আক্রমণ করি। এখানে কয়েকজন পাকসেনা আহত হয়। যুদ্ধের একপর্যায়ে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। করিমপুর ব্রিজের যুদ্ধে অংশ নেয়ার কথা উল্লেখ করে মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়া বলেন, দেশে ফিরে লিকায়ত মৃধা কমান্ডারের নেতৃত্বে যুদ্ধ করি। তার সঙ্গে আমরা করিমপুর ব্রিজ যুদ্ধে অংশ নিই। দৌলতপুর থেকে ভাটিয়াপাড়ার উদ্দেশে রওনা দিলে সাধুহাটিতে এসে দেখি রাজকাররা ধান কেটে নিচ্ছে। এখানে ৮ জন মিলিটারি ও তিনটি লঞ্চভর্তি রাজাকার ছিল। আমরা এ্যাম্বুশ করি। শুরু হয় যুদ্ধ। ওরা নদীতে। আমরা বিভিন্ন ঝোপেঝাড়ে। চারদিক থেকে গুলি চলছিল বৃষ্টির মতো। হঠাৎ গুলি এসে লাগে দুই মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের গায়ে। তারা শহীদ হন। আহত হয় পাকবাহিনীর অনেকে। আমরা ধাওয়া দিলে একপর্যায়ে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরে করিমপুর রেললাইন বিচ্ছিন্ন করে দিই, যাতে তারা ভাটিয়াপাড়ার দিকে না আসতে পারে। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে লাল মিয়া বলেন, ভাটিয়াপাড়ায় আমাদের যুদ্ধ হয় ১৬-১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এর আগে থেকেই প্রতিদিন ভাটিয়াপাড়ার খোঁজখবর নিতাম। গোপনে রেকি করে আসতাম। ১৬ তারিখ যুদ্ধ হয়। ওরা প্লেন থেকে বোমা ফেলে। ১৯ তারিখ ১৪ দল একত্রিত হয়ে এ্যাম্বুশ করি। ৩ পাকসেনা গুলি খায়। আমাদের উপর্যুপরি গোলাগুলিতে রাজকাররা ক্যাম্প থেকে হাত উঁচিয়ে বের হয়ে আসতে থাকে। দুপুর ২টায় আমাদের কাছে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এভাবেই হানাদারমুক্ত হয় ভাটিয়াপাড়া। মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়া (মুক্তিবার্তা নং-০১০৯০৪১১১২, গেজেট নং-২৯৪০ ও সনদ নং-১৪০২৫৮) বলেন, শরীরটা ‘ভাল নেই। অন্যের ওপর ভর করে চলতে হয়। ওষুধ খাওয়ারও টাকা নেই। দুবার স্ট্রোক করে শরীর এখন খুবই দুর্বল। চিকিৎসা করাতে গিয়ে যা টাকা ছিল নষ্ট হয়েছে তাও। কোন উন্নতি হয়নি।’ ঠিকমতো মাসিক ভাতা পাচ্ছেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘মাসিক ভাতা ১০ হাজার টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও আমি পাচ্ছি ৪ হাজার ৯শ’ টাকা। ঋণ নিয়েছিলাম দুই লাখ, সেই টাকা মাসিক ভাতা থেকে কেটে রাখা হচ্ছে।’ একটু সুস্থভাবে বাঁচার জন্য তিনি এই প্রতিবেদককে শুনিয়ে বসেন, ‘আমার চিকিৎসার জন্য আপনি কী করতে পারবেন?’ মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়ার স্ত্রী জুলেখা বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে তিনি খুবই অসুস্থ। কোন খাবার খেতে পারেন না। নিজে চলাফেরা করতে পারেন না। ধরে নিয়ে যেতে হয়। তিনি বলেন, ঋণ নেয়ায় তিনি এখন মাত্র ৫ হাজার টাকা পান। সেই টাকা দিয়ে ওষুধ খরচাই চলে না। প্রতিদিন ৩শ’ টাকার ওষুধ লাগে। কেউ সাহায্য করে কিনাÑ এমন প্রশ্নে জুলেখা বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে-মধ্যে দেখতে আসেন। কমান্ডার সাহেব কয়েক দিন আগে দেখে গেছেন। কেউ পাশে দাঁড়ালে হয়ত তিনি তার চিকিৎসা পেতেন। পারিবারিকভাবে এই মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে না পারার তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন নড়াইল গ্রামের একাধিক ব্যক্তি। ওই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ময়েন উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, লাল মিয়া বর্তমানে খুবই অসুস্থ। আর্থিকভাবে অসচ্ছল ও দুস্থ হওয়ায় ঠিকমতো নিজের চিকিৎসা করাতে পারছেন না। একই গ্রামের বয়োবৃদ্ধ আহাদ শেখ (৮০) জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে তিনি খুবই অসুস্থ। কয়েকবার স্ট্রোক করেছেন। হাসপাতালেও ছিলেন দীর্ঘদিন। টাকা-পয়সা না থাকায় নতুন করে ডাক্তার দেখাতে পারছেন না। ফলে তার চিকিৎসাও হচ্ছে না। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মহেশপুর ইউনিয়ন কমান্ডার কাজী আকবর হোসেন বলেন, মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়া বিছানায় শায়িত আছেন। অর্থাভাবে তার চিকিৎসা হচ্ছে না। তার চিকিৎসার জন্য কাশিয়ানীর ইউএনওর কাছে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু এখনও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।
×