ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সন্তোষ কুমার দেব

সম্ভাবনাময় পর্যটন খাত

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ২ অক্টোবর ২০১৬

সম্ভাবনাময় পর্যটন খাত

পর্যটন এমন একটি শিল্প- যা বহু দেশের অর্থনৈতিক খাতের অন্যতম উপাদান। এ শিল্প এখন বিশ্বব্যাপী একটি দ্রুত বিকাশমান খাত হিসেবে চিহ্নিত। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ছাড়াও বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পর্যটন অনেক দেশেরই শীর্ষ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্পে পরিণত হয়েছে। পর্যটন একটি ব্যতিক্রমধর্মী রফতানি-বাণিজ্য। অন্যান্য ক্ষেত্রে সাধারণত বিদেশে পণ্য পাঠিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয়। কিন্তু পর্যটনের ক্ষেত্রে বিদেশীদের দেশ ভ্রমণে আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন ধরনের সেবা ও সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা হয়। পর্যটনে বিদেশী পর্যটক নিজের দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণে এসে থাকা-খাওয়া, যাতায়াত বিনোদন ইত্যাদিতে যে অর্থ ব্যয় করে, তা অন্য দেশের বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে অর্জিত হয়। পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হোটেল, মোটেল ও অন্যান্য সহসংস্থার অর্জিত অর্থ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পণ্য রফতানির তুলনায় পর্যটন শিল্প থেকে আয়ের পরিমাণ দ্রুত বর্ধনশীল। কোন এলাকায় পর্যটন অঞ্চল গঠন ও উন্নয়নের ফলে সেখানে পর্যটকের সমাগমের মাধ্যমে অর্থপ্রবাহ সৃষ্টি হয়। কম শিল্পায়িত এলাকায় পর্যটন শিল্পের বিকাশের ফলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়, যা আশপাশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে। পর্যটনকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বের বহু দেশ প্রমাণ করেছে, পর্যটন অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম মাধ্যম। সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, হংকং, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জাতীয় আয়ের একটা বড় অংশ অর্জিত হয় এখাত থেকে। মালদ্বীপের অর্থনীতির প্রধান অংশ পর্যটন খাতের ওপর নির্ভরশীল। ইউএনডব্লিউটিওর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫০ সালে বিশ্বে পর্যটকের সংখ্যা ছিল মাত্র আড়াই কোটি। ২০১২ সালে বেড়ে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৫ কোটি। অঞ্চলভিত্তিতে ২০১২ সালে সবচেয়ে বেশি পর্যটকের আগমন ঘটেছে ইউরোপ, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। ২০১২ সালে বিশ্ব পর্যটন আয় জিডিপির ৯ শতাংশ, যা বিশ্ব রফতানির ৬ শতাংশ। এর রফতানিমূল্য ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই খাতে প্রতি ১০ জনে একজনের কর্মসংস্থান হয়েছে। বাংলাদেশেও রয়েছে অসংখ্য নৈসর্গিক, প্রতœতাত্ত্বিক, ধর্মীয় নিদর্শন ও স্থান। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকন করা যায় সমুদ্রকন্যা পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বিচ, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, যা বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি হিসেবে পরিচিত; হিমছড়ি ঝরনা, ইনানী সমুদ্রসৈকত, হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, মহেশখালী, টেকনাফ, টাঙ্গুয়ার হাওড়, হাকালুকি হাওড়, কাপ্তাই, বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকা, চট্টগ্রামের দিগন্তজোড়া সবুজ আর পাহাড়ের গা ঘেঁষে যাওয়া আঁকাবাঁকা লেক, মায়া হরিণের জাদুমাখা সোনার চর, নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার সিলেটের জাফলংয়ের পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ পানিতে মাছের খেলা। ঐতিহাসিক প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর পাহাড়পুর, কুমিল্লার ময়নামতি, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, ঢাকার লালবাগ কেল্লা, ষাট গম্বুজ মসজিদ, আহসান মঞ্জিল ও কুষ্টিয়ার লালন শাহের আখড়া। রয়েছে ঐতিহাসিক কীর্তির ঐতিহাসিক স্থান, যেমন জাতীয় স্মৃতিসৌধ, জাতীয় শহীদ মিনার, জাতীয় কবির কবরস্থান, বাহাদুর শাহ পার্ক, রমনার বটমূল, কার্জন হল ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে তার অপরূপ সৌন্দর্যে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালে পর্যটন খাত থেকে বাংলাদেশ আয় করেছিল ২৬৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ২০১০ সালে এসে আয় দাঁড়িয়েছে ৫৫৬ কোটি ২৭ লাখ টাকায়। বাংলাদেশ ভ্রমণকারী পর্যটকের সংখ্যা ২০০১ সালে ছিল দুই লাখ সাত হাজার ১৯৯ জন এবং ২০০৮ সালে এযাবত কালের সবচেয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক চার লাখ ৬৭ হাজার ৩৩২ জন। ওয়ার্ল্ড ট্র্যাভেল এ্যান্ড টুরিজম কাউন্সিলের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১২ সালে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) পর্যটন শিল্পের সরাসরি অবদান ছিল ২ দশমিক ১ শতাংশ। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়াাবে ৪ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ২৭ লাখ লোকের। এর মধ্যে প্রায় ১৩ লাখ সরাসরি পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত। কর্মসংস্থানের এই প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৮ শতাংশে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৩ দশমিক ২ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশকে সারা বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল ১০টি পর্যটন মার্কেটের একটি হিসেবে ভাবা হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি ধরা হচ্ছে। ২০২০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটি। কারণ, মানুষের অবসর দিন দিন বাড়ছে আর হাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে টাকা, যা খরচ করার জন্য পর্যটনকেই মানুষ বেছে নেবে। পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বিপুলসংখ্যক পর্যটকের মধ্যে প্রায় ৭৩ শতাংশ ভ্রমণ করবে এশিয়ার দেশগুলোয়। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার তথ্য মতে, ২০১৮ সালের মধ্যে এ শিল্পে ৩৫ কোটি ৭০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ১০ দশমিক ৫ ভাগ। বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজার ধরতে পারে, তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় পর্যটনশিল্প বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন। সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে পর্যটনপণ্যের সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার অভাব, অপ্রতুল অবকাঠামো ও অপর্যাপ্ত পর্যটন স্থাপনা, নিম্নমানের যোগাযোগ ব্যবস্থা, মানসম্মত আবাসনের অভাব, সমন্বিত পর্যটন আইন কাঠামোর অভাব, উপযুক্ত বিনোদন ব্যবস্থার অভাব, সুষ্ঠু পর্যটন নীতিমালার অভাব, সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগের অভাব, সাবলীল উপস্থাপনা ও প্রচারের অভাব। এসব সমস্যার সমাধানে সব পর্যটন স্থানের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা খুব দরকার। পর্যটন স্থানগুলোয় উন্নতমানের হোটেল, মোটেল ও বিনোদনের ব্যবস্থা করাতে হবে। দক্ষ ও পেশাদার জনবল তৈরি করতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করতে হবে, যাতে পর্যটকরা নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারে। পর্যটন শিল্পের বিকাশের জন্য উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও মুক্ত মনের প্রয়োজন। এ পদক্ষেপগুলোর যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমেই বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এক উল্লেখযোগ্য খাতে পরিণত হতে পারে।
×