ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমার কথা

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

আমার কথা

সৈয়দ আবুল হোসেনের ‘আমার কথা’ গ্রন্থটি প্রকাশ পায় ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে। বইটি মূলত লেখকের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের এক প্রচ্ছন্ন দলিল। ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা, বেড়ে ওঠা, নিজের জীবন গড়ে তোলা, সৃষ্টিশীল জগত তৈরি করা সর্বোপরি নিজেকে একজন যথার্থ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার এক অনবদ্য জীবন কথা লেখকের এই আত্মকথনমূলক লেখাটি। একেবারে শিশু বয়স থেকে নিজের জীবনের স্পর্শকাতর অনুভূতি দিয়ে গ্রন্থটি শুরু করেন গ্রন্থকার ‘আমার অনুভব’ অধ্যায়ের শুরুতেই। লেখাটি যেহেতু লেখকের নিজের সম্বন্ধে সুতরাং বইটির রূপকার সৈয়দ আবুল হোসেন নিজের দর্পণে, আপন অভিজ্ঞতায়, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভূতির কোমল অনুভবে নিজেকে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। ব্যক্তি মানুষের অভ্যাস, তার সামাজিক প্রতিবেশ এবং চেতনার উৎকর্ষতার যে সহজাত বোধ সেটাই লেখককে জীবনভর চালিত করে। তার প্রতিটি শব্দচয়ন এবং বাক্যের গঠন শৈলির নির্মাণ কৌশল আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়। বর্তমান সময়ের ধর্মীয় উন্মাদনা, হানাহানি, সংঘর্ষ এবং পীড়ন লেখককে উদ্বিগ্ন করে। ভাবেন, ষাটের দশকে তার বেড়ে ওঠায় ধর্মীয় মূল্যবোধ তাঁকে কতখানি উদার আর সহনশীল করেছিল। পারিবারিক ধর্মীয় আবহের মধ্যে বড় হয়ে ও সমস্ত অপসংস্কার এবং সঙ্কীর্ণতা থেকে কতখানি মুক্ত ছিলেন তা স্মরণ করে বলেছেন, ‘আমি ধর্মকে মর্মমূলে লালন করেছি বিকাশের মুগ্ধতায়।’ আর্থ-সামাজিক বলয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর রাজনীতির অঙ্গনে অনুপ্রবেশ জীবনের এক যুগান্তকারী ঘটনা। রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকে দেশের সাধারণ মানুষ এবং তাদের প্রতি দায়িত্ব এবং কর্তব্যবোধ। গ্রন্থের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক জীবনের বর্ণনা দিতে গিয়ে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতায় তার অবিচল থাকার অভিব্যক্তি পাঠককে মুগ্ধ করবে। একজন কীর্তিমান, সুদক্ষ চালক তার পরিবারকে যেমন সংহত করে, সংসারে ভিত্তি দৃঢ় করে তেমনি একজন সফল রাজনীতিবিদ ও সামগ্রিক দেশের সত্যিকারের একজন বলিষ্ঠ পথনির্দেশক। নিজের জীবনের এই উপলব্ধির কথা গ্রন্থের রূপকার বার বার ব্যক্ত করেছেন। মানুষের চারিত্রিক কিছু ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য যে কোন ব্যক্তিকে সমৃদ্ধির শীর্ষে নিয়ে যাবার কথাও তার লেখায় পর্যায়ক্রমে এসেছে। সততা, নিষ্ঠা, পরিশ্রম, ধৈর্য, স্থিরচিত্ত, নিয়ম-নীতি, ঐতিহ্যিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধসহ নানাবিধ মানবিক গুণাবলী। জীবন ক্ষণস্থায়ী কিন্তু মহামূল্যবান। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষণকে সর্বোতভাবে কাজে লাগানোর কথা লেখকের ভাষায় দীপ্ত হয়ে ওঠে। যে কোন মানুুষ আদর্শিক এবং ব্যক্তিক মূল্যবোধ সমাজ ও রাষ্ট্রের গতিবিধি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে যা লেখককে ভেতর থেকে তাড়িত করে। সত্য ও ন্যায় সমাজ জীবনের এক বিশিষ্ট অঙ্গীকার এ প্রত্যয়ে ও লেখককে বিভিন্নভাবে আলোড়িত হতে দেখা যায়। যা প্রতিটি সময়, যুগ এবং কালের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। মাতৃভাষার প্রতি গ্রন্থকারের গভীর মমত্ববোধ পাঠককে মুগ্ধ করবে। ভাষা আন্দোলনের ঐতিহ্যিক মূল্যবোধ আজও তাঁকে অভিভূত করে রাখে। দেশের সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রচলন নিয়ে তার আবেগ এবং উৎকণ্ঠা নিজের ভাষার প্রতি তার অকৃত্রিম বোধের পরিচয় বহন করে। স্মৃতিতে আজও অম্লান হয়ে আছে, বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার সেই স্মরণীয় মুহূর্তটি। যাঁর আকর্ষণীয় নেতৃত্বে মুগ্ধ লেখক পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সংগঠনটির সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। সফল ব্যবসায়ী এবং সৃষ্টিশীল লেখক সৈয়দ আবুল হোসেন রাজনৈতিক অঙ্গনে কৃতিত্বের চিহ্ন রাখেন। স্মৃতি চারণের মধ্য দিয়ে এ বক্তব্যগুলো তার গ্রন্থটিতে নানাভাবে সংযোজিত হয়েছে। তিনি পর পর চারবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার কথা গ্রন্থে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। নিষ্ঠার সঙ্গে নির্বাচিত এলাকায় দায়িত্ব পালনে কখনও পিছপা হননি বলেও দাবি করেছেন। যোগাযোগমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে তাঁকে নিয়ে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন। এ নিয়ে তাঁর নিজের পক্ষে যুক্তিও খাড়া করেছেন। তাঁর লেখনীতে এসেছে তাঁর বিরুদ্ধে পদ্মা সেতুকে নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সমস্ত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। নিজের ভাবানীতে লেখকের এই আত্মকথনমূলক গ্রন্থটি শুধুমাত্র ব্যক্তিক জীবনের অনুভূতিই নয়, দেশ, জাতি, রাজনীতি, স্বাধীনতা, নেতৃত্ব, মাতৃভাষা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, আদর্শ- সব কিছুর মিলন গ্রন্থিতে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনগাঁথা। শব্দ চয়ন এবং বাক্য গঠনে লেখকের শৈল্পিক পরিচর্যা পাঠককে আনন্দ দেবে বললে বেশি বলা হবে না। তবে যে কোন সৃষ্টিকর্ম ত্রুটিবিচ্যুতির উর্ধে নয়। সৃজনশীলতা যেমন শিল্পসত্তাকে আবেগে তাড়িত করে তেমনি ফাঁকে ফাঁকে সুচিন্তিত মতামত ও শৈল্পিক দ্যোতনাকে ছাপিয়ে স্থির চেতনায় মগ্ন হয়। তার পরও বিচ্যুতি ঘটে লেখকের সঙ্গে গ্রন্থের গতিপথের, ধারাবাহিকতার এমনকি পুনরুক্তির নিরিখেও। অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অধ্যায়ের সমন্বিত ‘আমার কথা’ বইটি একই কথা, অনুভূতি অভিব্যক্তি দ্বিরুক্তির পর্যায়কে এড়াতে পারেনি। আর একটু সাবধান এবং সচেতন হলে এসব ত্রুটিবিচ্যুতি কাটানো সম্ভব। সুমন বৈদ্যের প্রচ্ছদ এবং পুথি নিলয়ের প্রকাশনা গ্রন্থটির গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। পাঠক সমাজে সমাদৃত হবে এই আশা ব্যক্ত করে লেখক সৈয়দ আবুল হোসেনকে আন্তরিক অভিনন্দন এবং বইটির সর্বাঙ্গীন সফলতা কামনা করছি।
×