ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আরও সাতদিন রাখা হবে

ওদের লাশ নিতে ১২ দিনেও কেউ আসেনি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৩ জুলাই ২০১৬

ওদের লাশ নিতে ১২ দিনেও কেউ আসেনি

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ জঙ্গীদের কেউই চায় না। এমন কি বাবা মাও না। লাশও বেওয়ারিশ পড়ে থাকে মর্গে। ১২ দিনেও কেউ আসেনি ওদের লাশ নিতে। পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগও করেনি। পড়ে আছে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) হিমাগারে। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্টুরেন্টে কমান্ডো অভিযানে নিহত এরা ৬ জঙ্গী। মরার আগে ওরা নির্মমভাব হত্যা করেছে ২০ জনকে। আগামী সাতদিনের মধ্যেও পরিবারের কেউ যোগযোগ না করলে তাদের মৃতদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করা হবে। হামলাকারী জঙ্গীরা হচ্ছে মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, রোহান ইমতিয়াজ, সাইফুল ইসলাম চৌকিদার, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম। ২ জুলাই বিকেলে মৃতদেহগুলো ময়নাতদন্তের জন্য সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেয়া হয়। তাদের পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য কোন জিজ্ঞাসা থাকলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রভোস্ট মার্শালের (০১৭৬৯০১২৫২৪) সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য আইএসপিআরের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে মোবাইল নম্বর দেয়ার পরও নিহত সাইফুলের বোন ও রোহানের বাবা ছাড়া আর কারও পরিবারই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। অবশ্য রোহানের বাবা তার ছেলের এই বিপথগামিতার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। নিহত ৬ জঙ্গীর ডিএনএ পরীক্ষার অনুমতি চেয়ে সোমবার আদালতে আবেদন করেছেন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির। একই সঙ্গে ছয় জঙ্গীর অস্থি-মজ্জা, রক্তমাখা জামাকাপড় আলামত হিসেবে জব্দ করার আবেদন করা হয়েছে। আদালত তা মঞ্জুর করেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত ও তথ্য প্রসিকিউশন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনার আমিনুর রহমান জানান, মামলার তদন্তের স্বার্থে মৃত ছয় জঙ্গীর পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাদের দেহের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য অস্থি-মজ্জা সংরক্ষণের আবেদন করা হয়েছে। যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে, তাদের পরিচয়ের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহের আবেদন করা হয়েছে। রক্ত, চুল ও জামাকাপড় আলামত হিসেবে জব্দ করার আবেদন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ১২ দিনেও ৬ হামলাকারীর লাশ নিতে তাদের স্বজনরা আসেনি। দুইজনের পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও তারা লাশ নেয়নি। এভাবে আরও সাতদিন জঙ্গীর মৃতদেহগুলো সিএমএইচে রাখা হবে। এ সময়ের মধ্যেও পরিবারের কেউ যোগযোগ না করলে তাদের মৃতদেহ আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করা হবে। একনজরে গুলশান হামলাকারীদের পরিচয় ॥ নিবরাস ইসলাম নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। সে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক মোনাস ইউনিভার্সিটির মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট সার্ভিসেসের কোষাধ্যক্ষ ছিল। ধনী পরিবারের সন্তান নিবরাস ইসলাম পড়ালেখা করেছে ঢাকার ইন্টারন্যাশনাল টার্কিশ হোপ স্কুলে। মোনাসে ভাল না লাগায় দেশে ফিরে নিবরাস ভর্তি হয় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওয়ারি আর উত্তরায় বাড়ি আছে তার ব্যবসায়ী বাবার। নিবাসের তিন চাচার মধ্যে একজন সরকারের উপ-সচিব, একজন পুলিশ কর্মকর্তা, আরেকজন বিজ্ঞানী। মীর সামেহ মুবাশ্বের ও রোহান ইমতিয়াজ দুজনেই স্কলাসটিকা স্কুলের সাবেক ও বর্তমান ছাত্র। মুবাশ্বেরের বাবা মীর হায়াত কবির এ্যালকাটেল-লুসেন্ট বাংলাদেশের কর্মকর্তা। মা খালেদা পারভীন সরকারী কলেজের শিক্ষক। বড় ভাই পড়ছেন কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে। মুবাশ্বের ‘এ লেভেল’ পরীক্ষার আগে গত মার্চে নিখোঁজ হয়। রোহানের বাবা ইমতিয়াজ খান বাবুল ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক, বাংলাদেশ অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশনের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল এবং বাংলাদেশ সাইক্লিস্ট ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারি। ২০ বছর বয়সী রোহান স্কলাসটিকা শেষ করে পড়ছিল ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে। তার মাও নামী ওই স্কুলের শিক্ষক। শফিকুল ইসলাম ও খায়রুল ইসলাম উভয়ের বাড়ি বগুড়ায়। এর দুজন অবশ্য বাকিদের মতো উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান নয়। গুলশান হামলার ঘটনায় আহত হলি আর্টিজানের দুই পাচক সাইফুল ইসলাম চৌকিদার ও জাকির হোসেন শাওনকেও সন্দেহ করা হচ্ছে। তারা দুজনই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তাদের জঙ্গী হিসেবে সন্দেহ করছে সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্তকারী সংস্থা। হামলাকারীদের মৃতদেহ ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ সোহেল মাহমুদ জনকণ্ঠকে জানান, গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলার ঘটনার ২৮ জনের মরদেহ ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতজন হামলাকারী বলে ধারণা করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এদের মধ্যে ছয়জনকে সিএমএইচে। বাকি একজন শাওনের লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে। হামলাকারী ছয়জনের লাশের শরীরে বোমা স্প্রিন্টারের চিহ্ন ছিল। যা বোমা বিস্ফোরণে হয়েছে বলে মনে হয়েছে। আবার গুলির চিহ্নও ছিল। তিনি জানান, তাদের লাশ হিমাগারে রাখা হয়েছে। ঢামেক হাসপাতালে আহত দুই হামলাকারীর পরিচয় ॥ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলার পর উদ্ধারকৃতদের মধ্যে চারজনকে সন্দেহে রেখেছে তদন্তকারীরা। তাদের মধ্যে জাকিরুল ইসলাম (২২) ও নজরুল সারেনকে (৫০) আহত অবস্থায় আটক করা হয়েছে। তারা দুজনই এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পুলিশ পাহারায় চিকিৎসাধীন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, গুলশান হামলার পর জীবিত অবস্থায় উদ্ধারকৃতদের মধ্যে জাকিরুলকে প্রধান সন্দেহে রাখা হচ্ছে। বগুড়ায় তার বাড়ি। জাকিরুল ঘটনার মাত্র এক মাস আগে ও’কিচেন রেস্টুরেন্টে চাকরি নেয়। গুলি ও বোমার আঘাতে আহত জাকিরুলের অবস্থা সংকটাপন্ন। তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। ২ জুলাই অভিযান শেষে উদ্ধার তৎপরতা চলার সময় সিএনজি অটোরিক্সায় করে পালিয়ে যাচ্ছিলেন আহত সারেন। নতুনবাজার পুলিশ চেকপোস্টে তল্লাশি সময় আহত অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়। পাঁচ বিদেশীসহ উদ্ধারকৃত অপর ৩০ জনকেও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চারজনের মধ্যে এক বা একাধিক ব্যক্তি হামলার প্রক্রিয়া সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। আহত দুজন সুস্থ হলে তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) ও গুলশান বিভাগের দুই কর্মকর্তা বলেন, ঘটনার পর থেকেই জাকিরুলকে ব্যাপকভাবে সন্দেহ করা হচ্ছে। তার অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় তাকে দ্রুত চিকিৎসা দেয়া হয়। সারেন হাসপাতালে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদে সন্তেষজনক উত্তর দিতে পারেনি। এ ঘটনায় প্রথম প্রতিরোধেই প্রাণ হারায় পুলিশের দুই কর্মকর্তা। পরদিন সকালে সেনা কমান্ডো অভিযানে ছয় সন্ত্রাসী নিহত হলেও তারা আগেই ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে ১৭ বিদেশীসহ ২০ জনকে হত্যা করে। পরদিন শনিবার সকালে কমান্ডো অভিযান চালিয়ে জিম্মি সঙ্কটের অবসানের পর দুপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়, সন্দেহভাজন ছয় হামলাকারী নিহত হয়েছে এবং একজন ধরা পড়েছে।
×