ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

উদ্ভট উটের পিঠে কি চলেছে স্বদেশ?

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৫ মে ২০১৬

উদ্ভট উটের পিঠে কি চলেছে স্বদেশ?

(গতকালের চতুরঙ্গ পাতার পর) উচ্চ আদালতে প্রায়ই আদালত অবমাননার জন্য কাউকে না কাউকে ডাকা হয়। সেটি দু’ধরনের। একটি আদালতের আদেশ অমান্য করার জন্য। অন্যটি কোন মন্তব্য করা বা লেখার জন্য। আদালতের আদেশ না মানলে আদালতের অবমাননা নিশ্চয় হয়। কিন্তু, লেখা বা বক্তব্যের জন্য তা কেন হবে? কারণ, বক্তব্য বা লেখার সারমর্ম বোঝার বিষয়টা নির্ভর করে ধারণার ওপর। ধারণা, আইন, বিচার কি এক? তাত্ত্বিক আলোচনার জন্যই বিষয়গুলোর উত্থাপন, অন্য কোন কারণে নয়। বিচারপতি সিনহা প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ পাওয়ার পর যে কথা বলেছিলেন তাতে আমরা আশার আলো দেখেছিলাম। মামলা ভোগান্তি থেকে তিনি সাধারণকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ দিয়েছিলেন ২৬ বছর আগে। ২৬ বছর পর তার পরিবার ক্ষতিপূরণ পেলেন। এটি কি বিচার? না প্রহসন? এ ধরনের মামলার আলোকেই প্রধান বিচারপতির ভাষণকে আমরা স্বাগত জানিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর থেকে তিনি যে সব নির্দেশ বা বক্তব্য দিচ্ছেন তা নিয়ে সর্বস্তরেই আলোচনা চলছে। এই আলোচনা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে এবং বিভ্রান্তি ক্ষোভের সৃষ্টি করে। পরিণামে তা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করে। সে জন্যই মূল প্রশ্ন ছিল যা ভূমিকাতে উল্লেখ করেছি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আমরা এক হিসেবে বিবেচনা করব কিনা। এখন রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগই আলাদা। বিচারপতি অবশ্য বলেছেন জুডিশিয়ারি সংবিধানের অংশ। বাকিগুলি? বইপত্রে আমরা পড়েছি যে, তিনটির মর্যাদাই সমান, তিনটিই সংবিধানের অঙ্গ, শুধু জুডিশিয়ারি নয়। আগে আমরা বলতাম, বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের অধীন বিশেষ করে নিম্ন আদালত। এখন বিচার বিভাগ স্বাধীন, বিচারকদের পে স্কেল আলাদা। সুযোগ সুবিধাও বেশি পাচ্ছেন। তবুও ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে বিচারকদের বেতন সুবিধা সর্বোচ্চ হওয়া উচিত। কারণ, একজন বিচারকের পরিশ্রম একজন সচিব বা জেনারেলের সঙ্গে তুলনীয় নয়। যাক, সে অন্য প্রসঙ্গ। তিনটি অঙ্গই আলাদা। তিনটিই স্বাধীন। আমরা আইন ও নির্বাহী বিভাগ সম্পর্কে নরম থেকে কঠোর সমালোচনা করতে পারি, করার অধিকার আছে, সংবিধান অনুযায়ী, তাহলে বিচার বিভাগের সমালোচনা করলে তা অবমাননার পর্যায়ে পড়বে কেন? আমরা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের কর্মকা-ের সমালোচনা করতে পারি, তাদের নয় কেন? একজন সংসদ সদস্য অভাবনীয় আচরণ করলে পত্রিকার খবর হতে পারেন কিন্তু বিচারক করলে খবর করা যাবে না কেন? সংসদ সদস্য যে আইন করেন, সে আইনেই তো বিচার হয়। আগে সেনাবাহিনী সম্পর্কে কোন মন্তব্য করা যেত না। বলা হতো স্পর্শকাতর বিষয়। কারণ তারা অস্ত্রের সাহায্যে যা তা করতে পারত। এখন বিচারালয় সম্পর্কেও বলা হয় স্পর্শকাতর। কেন? বিচারালয় স্বাধীন দেখেই অন্যান্য স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের মতো সে প্রতিষ্ঠানেও গলদ থাকতে পারে, দুর্নীতি হতে পারে। সেটি আলোচনায় আসবে না কেন? জনগণের করের টাকায় যা চলবে তাকেই আলোচনার সম্মুখীন হতে হবে এবং সমালোচনা ন্যায্য হলে তা মানতে হবে। কেননা, যারা বেতন পান রাষ্ট্র থেকে তাদের সবার দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। ভারতে, একটি নাগরিক গ্রুপই আছে যাদের একমাত্র কাজ আদালতের বিভিন্ন সংস্কারের জন্য দাবি তোলা ও সরকারের মতামত সংগঠন করা। তাদের কখনও আদালত অবমাননার জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি। এ কথাগুলো বাধ্য হয়েই বলতে হলো। একটি উদাহরণ দেই। বিচারপতি ওয়াহাব মিয়ার অনেক রায়ের সঙ্গে আমরা একমত নই এবং তার কঠোর সমালোচনাও করেছি। কিন্তু, আমার মনে হয়েছে তিনি বিষয়টি বিবেচনা করেছেন এভাবে যে তার মত তার, আমার মত আমার। এরপর তার এজলাসে অনেক শুনানিতে গেছি। দেখেছি তিনিও প্রশ্ন করেন, কিন্তু সেটি জানতে। কখনও তা অস্বস্তিকর মনে হয়নি। ভীতিও গ্রাস করেনি। বিচারালয় তো এরকমই হওয়ার কথা। কিন্তু এখন কেন মনে হয়, কী মনে হয় না বললাম। কেননা, প্রধান বিচারপতি এমন সব মন্তব্য বা নির্দেশ দিচ্ছেন যা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যদি অন্য বিচারপতিরা তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন তাহলে বলতে হবে, তিনি একা নন, অন্যদের ক্ষেত্রেও একই মন্তব্য প্রযোজ্য। কেননা, ঘন ঘন আদালত অবমাননার ঘোষণা বিচারালয়কে সমুন্নত করে না বরং প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা প্রকাশ করে। সে দুর্বলতার দায় ব্যক্তির না প্রতিষ্ঠানের তা অন্যরা বিচার করবেন। এর আগে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী, বিচারপতি খায়রুল হক আদালত অবমাননার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন। তবে বিচারপতি খায়রুল হক খুব সম্ভবত আদালতের নির্দেশ না মানার জন্য মাহমুদুর রহমানকে আদালত অবমাননায় দ- দিয়েছিলেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাউকে ডাকেননি। বিচারপতি চৌধুরী ডেকেছেন। বর্তমান প্রধান বিচারপতিও ডেকেছেন। তারা কাকে ডেকেছেন, সেটি ভাল না মন্দ সেসব বিষয়ে যাব না। আমার আলোচনাটি ভিন্ন। আদালত কিসের ভিত্তিতে চলে? আইনের ভিত্তিতে। দ- কোন্্ ভিত্তিতে দেয়া যায়? আইনে উল্লিখিত বিধান অনুযায়ী। এখন আপীল বিভাগ আদালত অবমাননা সম্পর্কিত আইনের অভাব আছে শুনেছি। প্রাক্তন বিচারপতিরাই তা বলছেন। তাহলে আদালত অবমাননার জন্য ব্যক্তিকে ডাকা হচ্ছে কোন্্ আইনের ভিত্তিতে? আইনে দ-ের বিধান না থাকলে দ- দেয়া হচ্ছে কিসের ভিত্তিতে? ধারণাগত ভিত্তিতে। আইন ও ধারণা এক কিনা? যদি না হয় তাহলে বিচার হয় বিরাগের ভিত্তিতে। সেটি বিচারপতিদের শপথের সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ? এ প্রশ্নগুলো উঠছে। প্রধান বিচারপতির সাম্প্রতিক যে নির্দেশটি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে তা হলো, বিচারকদের অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখা নিয়ে। তিনি বলছেন, অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখা যাবে না। মানলাম সেটা। কিন্তু সিদ্ধান্তটি কি একার না সবার? ঠিক আছে ধরে নিলাম একার, কিন্তু তিনি আগে যা বলেছেন তার সঙ্গে এটি কতটা সঙ্গতিপূর্ণ? সংবিধানের সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ? সংবিধানের বাইরে আদালতের যাওয়ার এখতিয়ার কতটুকু? সংসদে একক সিদ্ধান্তে কিছু হয় না। নির্বাহীতেও নয়। জুডিশিয়ারিতে কেন হবে? প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, মামলার জট কমাবেন। কিন্তু প্রাক্তন বিচারপতি বিরাট সংখ্যক মামলার রায় যে পুনঃশুনানির নির্দেশ দিলেন, তাতে জট বাড়বে না কমবে? যে মামলার রায় দেয়া হয়েছে উন্মুক্ত আদালতে, যে মামলার রায় লেখা হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে তা অন্যান্য বিচারপতির কাছে গেছে তার পুনঃশুনানি হবে কিভাবে? রায় প্রকাশের পর রিভিউ হতে পারে। সবচেয়ে বড় বিষয়, পুনঃশুনানির সময় আদালতে যে আইনজীবী দাঁড়াবেন তার ফিস কে দেবে? যে মক্কেল একবার ফিস দিয়েছেন তিনি ফের একই বিষয়ে কেন ফিস দেবেন? (চলবে)
×