ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শেষ মুহূর্তের মূল্যবান সময় ধুয়ে গেল ফাগুনের বৃষ্টিতে

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

শেষ মুহূর্তের মূল্যবান সময় ধুয়ে গেল ফাগুনের বৃষ্টিতে

মোরসালিন মিজান ॥ ও যার মনে মনে লাগে গো আগুন/ ফাগুন হাওয়া তার সয় না...। সইলো না ফাগুন হাওয়া। হয়ত তাই বর্ষার রূপ। হঠাৎ করেই বৃষ্টি। ফাগুনের বৃষ্টিতে ধুয়ে গেল বইমেলার গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। প্রতিবারই এমন দু’ একটা দিন চলে আসে। এবারও ব্যতিক্রম হলো না। অমর একুশে গ্রন্থমেলার ২৪তম দিনে আর সব গল্পকে পেছনে ফেলে সামনে এসে দাঁড়াল বৃষ্টি। মঙ্গলবার রাতেই একপশলা হয়েছিল। বুধবার সকালে এমনকি শিলাবৃষ্টি! মাঝখানে থেমেছিল বটে। যেই না মেলা শুরু হবে, অমনি ঝড়ো হাওয়া। তুমুল বৃষ্টি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রকাশকরা। কারও কারও বেলায় এটি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। শেষ সময় হওয়ায়, পাঠকও এখন বই কেনায় বেশি মনোযোগী। বৃষ্টি বিঘিœত দিনে তাঁদেরও মন খারাপ ছিল। তবু প্রাণের মেলা বন্ধ থাকেনি। অল্প সময়ের জন্য হলেও চলেছে। বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সবার জন্য খুলে দেয়া হয় প্রবেশদ্বার। প্রতীকী এই খুলে দেয়ার মানে, ‘বন্ধ’ শব্দটিকে প্রশ্রয় না দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন শুরু হয়ে শেষ দিন পর্যন্ত চলবে। এই চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারের কথাই যেন স্মরণ করিয়ে দেয় আয়োজক একাডেমি। বুধবার বেলা তিনটার আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে দেখা যায়, বৃষ্টিতে অনেক নিচু জায়গা তলিয়ে গেছে। মূল প্রবেশ পথ দিয়ে সামনে কয়েক পা এগোনো যায়। এর পর যেন ছোট্ট পুকুর। বাংলা প্রকাশ, ধ্রুপদ, তাম্রলিপি, শিল্পতরু, সময়, জাগৃতিসহ এই অংশের অধিকাংশ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে বাইরে জল থৈ থৈ করছিল। জুতো হাতে নিয়ে এ জায়গা অতিক্রম করতে হয়েছে। এ অবস্থাতেই স্টল ও বই রক্ষার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন কর্মীরা। এ সময় ভ্যানে করে প্রচুর বই সরিয়ে নিতে দেখা যায়। উদ্যানের মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকালে দৃশ্যমান হয় ভিজে একাকার অধিকাংশ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টল। কোন কোনটি একেবারে বিদ্ধস্ত। এমনকি বর্ধমান হাউসের আদলে গড়া বাংলা একাডেমির প্যাভিলিয়নের ছাদ সম্পূর্ণভাবে ধসে পরে। এ অংশের নিচু জায়গাগুলোতে পানি জমে ছিল। স্টলের সামনে কাঁদা জমে কৃষি জমির অবস্থা হয়েছিল। অধিকাংশ স্টলের সামনে ভেজা বই যতটা সম্ভব শুকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এদিন, প্রায় অর্ধশত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টল বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছে শিকড়, তাম্রলিপি, অবসর, মিজান পাবলিশার্স, অন্যপ্রকাশ, সংহতি, স্টুডেন্ট ওয়েজ, সাহিত্যপ্রকাশ, সময় প্রকাশন, অন্বেষা প্রকাশন, ডেইলি স্টার বুকস্্, চারুলিপি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, নালন্দা, অনন্যা, জার্নিম্যান বুকস, পুঁথিনিলয়, গ্রন্থকাননসহ বেশ কয়েকটি। স্টলের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্টলের উপরে থাকা ত্রিপলে ছিদ্র থাকায় বৃষ্টির পানি সহজেই স্টলে প্রবেশ করেছে। পানি জমে যাওয়ায় ভিজেছে স্টলের মেঝে ও ডিসপ্লেতে রাখা অনেক বই। মিজান পাবলিশার্সের স্বত্বাধিকারী মিজানুর রহমান পাটোয়ারি জানান, বেশ মজবুত করেই তিনি স্টল নির্মাণ করেছিলেন। এর পরও স্টলের উপরের অংশ ভেঙে পড়েছে। সব ঠিক করে দ্রুত মেলায় ফেরার চেষ্টা করছেন বলে জানান তিনি। স্টলের ভারসাম্যহীন ডিজাইনের কারণেই হয়ত ভেঙে পরে অন্য প্রকাশের উপরের অংশ। মেলায় ই-বুক ও অডিও বুকের দারুণ একটি সংগ্রহ নিয়ে অংশ নিয়েছিল জার্নিম্যান বুকস। তথ্য প্রযুক্তির সঙ্গে পথচলার এই সময়ে স্টলটি তরুণদের আকৃষ্ট করে রেখেছিল। এখানে অনেক টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছিল। সেগুলোরও ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। এ সম্পর্কে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মালিক কবি তারিক সুজাত বলেন, বেশিরভাগ যন্ত্রে বৃষ্টির পানি প্রবেশ করেছে। অনেক টাকা মূল্যের অডিও কিয়স্ক ভিজে গেছে। কিন্তু বিদ্যুত সংযোগ না পাওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ এখনও জানা সম্ভব হয়নি। বাংলা একাডেমি অংশেও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে যথেষ্ট। বেশ কয়েকটি স্টল ব্যাপকভাবে বিদ্ধস্ত হয়েছে। বুধবারের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ বলেন, অনাকাক্সিক্ষত বৃষ্টিতে অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে একাডেমির যা যা করা প্রয়োজন, করছে। মেলা যে কোন মূল্যে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে একাডেমি। তাই অল্প সময়ের জন্য হলেও মেলা চালু রাখা হয়। আজ বৃহস্পতিবার থেকে যথারীতি মেলা চলবে বলে জানান তিনি। নির্বাচিত বই ॥ আলাউদ্দিন আল আজাদের অগ্রন্থিত রচনা সমগ্র প্রকাশ করেছে অনিন্দ্য। কয়েকদিন আগে মেলায় এসেছে বইটি। এতে ১৫টি ছোট গল্প, ৫টি উপন্যাস, ২৬টি কবিতা ছড়া গান এবং ২০টি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। সম্পাদনা করেছেন এম আর মাহবুব। ভূমিকা লিখেছেন আনিসুজ্জামান। নাসরীন জাহানের উপন্যাসের একটা বিশেষ চাহিদা মেলায় লক্ষ্য করা যায়। সে চাহিদার কথা মাথায় রেখেই হয়ত অন্যপ্রকাশ বের করেছে লেখিকার ‘নিঃসঙ্গতার পাহারাদার’ উপন্যাসটি। গ্রন্থকানন থেকে এসেছে শাহজাহান আবদালীর লেখা ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’। আলোচনার শুরু ১৯৭০ সালের নির্বাচন দিয়ে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ নানা অধ্যায় বইতে যুক্ত হয়েছে। ১৯৭৫ সালের শোকাবহ ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির ইতিহাস আলোচনা করে শেষ করা হয়েছে ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শ্রাবণ মনে করিয়ে দিয়েছে শাহবাগের সেই উত্তাল দিনগুলোর স্মৃতি। ‘সংবাদপত্রে শাহবাগ’ শিরোনামের বইটিতে একটি ফিরে দেখা। সে সময় দেশের সকল দৈনিক পত্রিকায় গণজাগরণ মঞ্চের খবর গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। সেসব সংবাদ থেকে শাহবাগকে খুঁজে নিয়েছেন রাজীব মীর। কথাপ্রকাশ থেকে এসেছে ‘বহু হও ব্রহ্মা-ের মতো : ফের্নান্দো পেসোয়া ও তাঁর কবিতা’। অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন কুমার চক্রবর্তী। আগামী থেকে মেলায় এসেছে ‘মার্তি মনীষের প্রেতাত্মা’। অনুবাদ করেছেন আশরাফ আহমেদ। নান্দনিক থেকে এসেছে মিনার মনসুরের রাজনৈতিক নিবন্ধ সংকলন ‘আমার পিতা নয় পিতার অধিক’। মেলায় ঐতিহ্য থেকে এসেছে জাকির তালুকদারের উপন্যাস ‘আহ্নিক গতি’। লেখক একে বলেছেন, অন্য এক জগতের মানুষের গল্প। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ এদিন মেলা মঞ্চের আয়োজন স্থানান্তরিত হয় বাংলা একাডেমির ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ ভবনে। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তেন অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার ও মান উন্নয়নে সমস্যা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লেখক গবেষক আবুল মোমেন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কাজী ফারুক আহমেদ, মনজুর আহমদ এবং শাহিনুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলাম। প্রাবন্ধিক বলেন, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করে শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হলে এ খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে, অন্তত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জাতীয় উৎপাদনের ৬ ভাগ বরাদ্দ নিশ্চিত করা জরুরী। আমাদের বর্তমান বরাদ্দ ৩ ভাগেরও নিচে, পাকিস্তানসহ প্রতিবেশী সকল দেশের চেয়ে অনেক কম। বরাদ্দ এ পর্যায়ে রেখে মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষায় ছাত্রদের জন্যে মাথাপিছু সরকারী ব্যয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য বজায় রেখে দেশব্যাপী শিক্ষিত সমাজ তৈরির স্বপ্নও বাস্তবম্মত নয়। আলোচকরা বলেন, স্কুল পর্যায়ে সাংস্কৃতিক সাক্ষরতার পাঠ কালবিলম্ব না করেই শুরু করা উচিত। তবে স্কুলগুলোর এর জন্যে তেমন প্রস্তুতি নেই। সেক্ষেত্রে উপযুক্ত লোকবলের ঘাটতি পূরণের জন্যে শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় মিলে শিক্ষাকর্মীর স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি করতে পারে। পশ্চিমের উন্নত বিশ্বে যেমন উচ্চ মাধ্যমিকের পরে দু’বছরের জন্যে সেনাবাহিনী কিংবা সামাজিক কাজে যুক্ত হওয়ার বিধান আছে তেমনি একটি ব্যবস্থা এখানেও করা যায়। তারা বলেন, আমাদের দেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের শিক্ষাকর্মী হিসেবে সেবা দেয়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ করা যায়। তারা সাংস্কৃতিক ও জীবনশৈলীর পাঠ দেবে। সভাপতির বক্তব্যে ড. ফারজানা ইসলাম বলেন, একটি সার্বিক শিক্ষিত জাতি গঠনের অভিমুখে বাংলাদেশ অনেকদূর অগ্রগতি সাধন করেছে। এখন প্রয়োজন সর্বস্তরে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাতে দেশের সার্বিক সুষম উন্নয়নে শিক্ষিত প্রজন্ম তাদের প্রকৃত ভূমিকা পালন করতে পারে। সন্ধ্যায় একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন ‘সোসাইটি ফর ইউনিক ক্যাপাবল সিটিজেন্স’ এবং ‘গীতশতদল’র শিল্পীরা। সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী আবদুল আউয়াল, শারমিন সুলতানা, জাকির হোসেন, শ্যামল কুমার পাল, তপন চন্দ্র ম-ল, মির্জা শামসুল আলম, রীতা ভাদুরী, মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া, আবিদা রহমান সেতু এবং সুধীর মণ্ডল।
×