ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ ইন্দোনেশিয়া থেকে বি.বাড়ীয়া সঙ্কেত একটাই

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ১৭ জানুয়ারি ২০১৬

সিডনির মেলব্যাগ ॥ ইন্দোনেশিয়া থেকে বি.বাড়ীয়া সঙ্কেত একটাই

ইন্দোনেশিয়া তথা জাকার্তার ঘটনা দেখে দুটো বিষয় খুব মনে পড়ে গেল। প্রথমটি সে দেশে ইতোপূর্বে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী কর্মকা-ের পর বিচার পর্যায়ে এক তরুণের জবানবন্দী। বলে নিই কুখ্যাত বালি বোয়িং বা বালিতে দুর্ঘটনা ঘটার পর সস্ত্রীক বালি ভ্রমণে গিয়েছিলাম। পর্যটকদের স্বর্গ, একটু পর পর ঢাউস ঢাউস বিমানে নেমে আসা দুনিয়ার নানা দেশের পর্যটকদের দেখে মনে হবে না এখানে তেমন কিছু ঘটেছিল। বালি এক মনোরম মনোহর বড় সুন্দর ও মায়াবী তীর্থ, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এই দ্বীপ তটে বসে কবিতা রচনা করেছিলেন। সে মায়ার মধুর কথা আলাপের সময় নয় এখন। বালির অধিকাংশ বলতে গেলে নিরানব্বই শতাংশ আদিবাসী হিন্দু বলে সেখানে পর্যটন জমে উঠেছে। একই ধরনের নিসর্গ, আবহাওয়া ও পরিবেশ থাকার পরও জাভা বা সুমাত্রা দ্বীপে তা হয়নি। ইন্দোনেশিয়ার এই পর্যটন ভূমি তাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এক অনন্ত ভা-ার। তারপরও ছাড় পায়নি। সেখানে ঘটেছিল নৃশংস বোমা হামলা। ভ্রমণকালীন সময়ে তার রেশ না থাকলেও উদ্বেগ ছিলই বিশেষ করে যে সন্ধ্যায় আমরা সে জায়গাটি দেখতে গিয়েছিলাম। গা ছমছম করে উঠছিল আমার। খুব সাদামাটা একটা সৌধে উৎকীর্ণ নামগুলোর বেশিরভাগই ছিল অস্ট্রেলিয়ানদের। তারা কে কোন্ দেশ থেকে এসেছিলেন কেউ জানে না। তাদের দুর্ভাগ্য তারা বিদেশী ছিলেন। নিজের অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্টটি পকেটে রেখে ঘোরার সময় এই চিন্তা আমাকে সারাক্ষণ আছন্ন করে রেখেছিল। বলছিলাম বিচারের কথা। আদালতে দাঁড়ানো এক তরুণ সে হত্যাকা-ের দায় মাথায় নিয়ে বলেছিল যে, কোন বিচারে তার নাকি লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। টিভিতে প্রকাশ্য সম্প্রচারে এমন দম্ভোক্তি শুনে হতবাক মানুষের প্রশ্নের উত্তরে তার বক্তব্য ছিল ভয়ঙ্কর ও ভয়াবহ। সেদিনই মনে হয়েছিল লবঙ্গ বনে একদা বাম আদর্শের ঝড় দেখলেও এখন তার আকাশে ঘোর কালো মেঘ। সুকর্ণর পঞ্চশিলা নির্জোট আন্দোলনের পুরোধা দেশ ইন্দোনেশিয়ার ভবিষ্যত সুখকর নয়। অথচ এদেশেই সুহার্তোর বিদায়ের পর ইসলামী চিন্তাবিদ নামে পরিচিত আবদুর রহমান ওয়াহিদ এসেছিলেন ক্ষমতায়। যিনি অল্প সময় গদিতে থাকলেও তাঁর চমৎকার কথা ও দর্শনে আমার মতো অনেক মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। বিদায়ী সাক্ষাতকারে অতিথি ভবনের সামনে দাঁড়ানো এই নেতার পরনে ছিল হাফপ্যান্ট। ভাল করে চোখে দেখতে পেতেন না। অথচ অন্তরের দৃষ্টি ছিল স্বচ্ছ ও নির্মল। তিনিই প্রথম ব্যক্তি আমি যাঁর মুখে ফিলিস্তিনী সমস্যা সমাধানে ন্যায্য কথা শুনেছিলাম। স্পষ্ট জানিয়েছিলেন তিনি যুদ্ধ বা সর্বনাশের দায় নেবেন না। বরং ইসরাইলের সঙ্গেও সুসম্পর্ক স্থাপনে অঙ্গীকার ছিল তাঁর। প্রখর যুক্তিতে তিনি জানিয়েছিলেন, ইন্দোনেশিয়া যদি জাতিসংঘে স্বীকৃত ধর্ম অবিশ্বাসী রাষ্ট্র চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখতে পারে, তবে ধর্মে বিশ্বাসী ইসরাইলের বেলায় নয় কেন? শুনে চমকে উঠেছিলাম। ইসলামী চিন্তাবিদ নামে পরিচিত রাষ্ট্রপ্রধান ওয়াহিদ বলেছিলেন, তিনি অবসর কাটাবেন মোজার্ট আর সিম্ফনিতে। এমন আধুনিক ধর্মপ্রাণ মানুষের হাত থেকে ক্ষমতা যাওয়ার পর বুঝেছি সে দেশে শান্তি আসতে দেরি আছে। আজ যখন জাকার্তা বিশ্ব সংবাদের শিরোনাম মনে হয় এর পেছনে কি তাদের নিজেদের ভূমিকাই যথেষ্ট নয়? মিলগুলো দেখুন একনায়কতন্ত্র থেকে মুক্তি। গণতন্ত্রের বিজয় কামনা। কিছুদিন পর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সামরিক শাসন আর জনমত বা ভেতরের সন্ত্রাস বা উন্মাদনা চাপা দিয়ে রাখার প্রবণতা। এরপরই হঠাৎ তার এমন উদগ্র প্রকাশ। জাকার্তার দুর্ভাবনা আমাদের মতো চুনোপুঁটিদের দ্বারা সমাধানযোগ্য নয়। ফিরে আসি দেশের কথায়। ক’দিন আগে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় যা দেখলাম তাতে দেশের বাইরে আমাদের বুকের রক্ত হিম হয়ে গেছে। পরিকল্পিতভাবে ঘটানো না হলে এভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো অসম্ভব। এটা বুঝতে মেধার প্রয়োজন হয় না। টার্গেটগুলো দেখলেই বোঝা সম্ভব। এর আগে রামুর বৌদ্ধবিহার যেমন ছিল সাম্প্রদায়িকতার নিশানা। এবার তাই ঘটল আলাউদ্দীন খাঁর যন্ত্রপাতি ও শহীদ ধীরেন দত্তের নামের ওপর। পাঠাগার, সরোদ হারমোনিয়াম যাদের টার্গেট তারা কি আমাদের অচেনা বা অজানা? সেদিন কি খুব অতীত যেদিন শাপলা চত্বরে নতুন এক পাকি কায়দায় এদের জড়ো করা হয়েছিল। ভাগ্যিস সামাল দেয়া হয়েছে। কিন্তু নিরীহ নিরীহ বললে তো হবে না। ছেলে মদ-জুয়া হেরোইন আসক্ত হলে যেমন লুকিয়ে রেখে পার পাওয়া যায় না। উন্মাদনাও প্রকাশ্য হতে বাধ্য। গৌরব ও যুগোপযোগী ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে ভোটের ভয় তাড়াতে হবে। বঙ্গবন্ধু এদেশে যেভাবে যে উপায়ে যে মনোবলে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ বানিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন তার নাম আদর্শ; সেখানে ধর্ম বা মতবাদের বিরুদ্ধে কিছু ছিল না। ছিল না বলেই বাঙালী তাঁকে নয়নের মণি বানিয়েছিল। চাই জাতীয় শিক্ষাব্যবহার সমান বণ্টন, চাই আধুনিকতার সঙ্গে সংযোগ। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া আপাতত থেমেছে বটে। জাকার্তা কিন্তু বার্তা দিচ্ছে অধিক সাবধানতার। সরকার নিশ্চয়ই তা অনুধাবন করতে পারছে। [email protected]
×