ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাফর ওয়াজেদ

বদলে যাচ্ছে পৃথিবী

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ৪ ডিসেম্বর ২০১৫

বদলে যাচ্ছে পৃথিবী

‘অবাক জলপান’ নাটকের মুখ্য চরিত্র পথিক পানীয় জলের জন্য হা-পিত্যেশ করে একদল অবুঝের পাল্লায় পড়েছিল। এখন সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ স্বয়ং বিশ্বব্যাপী কিছু অবুঝ মানুষ। পরিবেশবিদদের মতে, এই মুহূর্তে দুটো মোক্ষম সমস্যার সামনে বিশ্বের পরিবেশ। প্রথমটি অবশ্যই বিশ্ব উষ্ণায়ন। আরও পরিচিত ভাষায় ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ বা ‘বিশ্ব উষ্ণায়ন’। এখন তার সঙ্গে জুটেছে পানীয় জলের সঙ্কট। এই দুই সমস্যার কারণে দেশের পরিবেশেও অদল বদল ঘটছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বার্কলে)-এর অধ্যাপক টিএন নরসিংহের আশঙ্কা, কয়েক দশক বাদে ভারতীয় উপমহাদেশ প্রবল পানি সঙ্কটের মুখে পড়বে। তবে তার কারণ প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়। এর মূলে রয়েছে উপমহাদেশবাসীর পানি অপচয়ের প্রবণতা এবং উষ্ণায়নের ফলস্বরূপ অতিরিক্ত বাষ্পীভবনও আর একটি কারণ। পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে গত ১০০ বছরে ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৮৫ ডিগ্রি (০.৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) বেড়েছে। এ যাবৎকালের ১৪টি উষ্ণতম বছরের মধ্যে ১৩টিই রেকর্ড করা হয়েছে একবিংশ শতাব্দীতে। এ ক্ষেত্রে ২০১৫ সাল উষ্ণতম বছরের আরেকটি নতুন রেকর্ড করতে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করেন, যেভাবে এখন কার্বন নির্গত হচ্ছে তাতে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২১০০ সালের মধ্যেই ২ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যাবে এবং তখন পৃথিবীর জলবায়ুতে বিপজ্জনক সব পরিবর্তন ঘটতে শুরু করবে। এর মধ্যে খরা, বন্যা, ঝড়, তাপপ্রবাহ ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়া, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, ফসল উৎপাদনের ধারায় পরিবর্তন, সুপেয় পানির সঙ্কট ইত্যাদি অনেক ধরনের সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমন বাড়ছে শিল্পকারখানা, কৃষি ও যানবাহনে তেল-কয়লা-প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়িয়ে শক্তি উৎপাদনের ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গমন বাড়ছে। শিল্পবিপ্লবের পর এই গ্যাস নির্গমন বেড়েছে ৩০ শতাংশ। গত আট লাখ বছরের মধ্যে এখন পৃথিবীর বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ এখন সবচাইতে বেশি। সমুদ্র জলে খাদ্য পিরামিডের সর্বনিম্ন স্তরে আছে প্ল্যাঙ্কটন জাতীয় ক্ষুদ্র জীব, যারা অন্য জলজ প্রাণীদের আহার্য। উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে প্ল্যাঙ্কটনের সংখ্যা দ্রুত কমছে। এন্টার্কটিকায় এমন বহু সামুদ্রিক প্রাণী ধীরে ধীরে অপসৃত হচ্ছে, যারা ওখানকার পেঙ্গুইনদের মুখ্য খাদ্য। ফলে নানা প্রজাতির পেঙ্গুইনের সংখ্যা কমছে। সুমেরু অঞ্চলের সমগ্র বাস্তুতন্ত্রই আজ বিপন্ন। খাদ্যাভাবে মেরুভাল্লুকদের ওজন এতটাই অস্বাভাবিক হারে কমছে যে, এরপর তাদের প্রজনন ক্ষমতা নিয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিপন্ন প্রাণীদের তালিকায় আজ তারা শীর্ষে! বরফগলা পানি সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়ে দিয়েছে। ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকূলবর্তী ও দ্বীপ অঞ্চলে। লবণাক্ত জলের পরিমাণ বাড়ছে, মুখ্য বৃষ্টিপাত ঘটছে মৌসুমী বাতাস চলে যাওয়ার পরে। এর ফলে যে সার্বিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, তাতে সেখানকার বাঘ ও হরিণ (বার্কিং ডিয়ার)-এর মতো অনেক প্রাণী আজ অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি। উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে প্রাণী দেহের বিভিন্ন শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। যেমন- বাসা বাঁধা আর মিলনের চিরাচরিত অভ্যেস। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে মাছ, কচ্ছপ, পরিযায়ী পাখীদের চলাচলের পরও। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, উষ্ণতা বৃদ্ধির এই বর্তমান ধারা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক চক্রেরই অন্তর্গত। উষ্ণ ও শীতল যুগের পর্যায়ক্রমিক আবর্তন পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। একুশ শতকের শেষে উষ্ণতা বৃদ্ধির পরিমাণ নাকি হবে ২-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে পার্বত্য হিমবাহ ও মেরু অঞ্চলের বরফ আরও গলছে। এতে ডুবে যেতে থাকবে বেশ কিছু উপকূলবর্তী অঞ্চল। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সুন্দরবনের বিভিন্ন দ্বীপ থেকে গত এক দশকে প্রায় দশ হাজার মানুষ কেবল এই কারণে ভিটে ত্যাগ করেছেন। অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চলেও এই দৃশ্য মেলে। একদিক থেকে দেখলে প্রাকৃতিক ক্রম পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রক্রিয়াই জৈব বিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি। যা সৃষ্টি করেছে এই বিপুল জৈব ঐশ্বর্য। সাম্প্রতিক সমস্যা কিন্তু অন্যত্র। উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রাকৃতিক কারণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানুষের অবদান। ফলে উষ্ণতা বৃদ্ধি তথা জলবায়ুর পরিবর্তনের ধারা এখন এতটাই দ্রুত যে, তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না প্রাণীদের অভিযোজন শক্তি। অরণ্যছেদন, ক্রমবর্ধমান নগরায়ন, বাতাসে গ্রীনহাউজ গ্যাসের আধিক্যÑ এই প্রতিটি ঘটনার পিছনে আছে মানুষের ক্রিয়াকলাপ। এ নিয়ে রাজনৈতিক বাগ্বিত-া যত চলেছে, সমাধানের লক্ষ্যে ততটা এগুলো যায়নি। মনুষ্যত্বের প্রাণীদের এই দুরবস্থা নিয়ে মানুষের উদাসীনতা বুমেরাং হয়ে তাদেরই আবার অস্তিত্বের সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড় করাবে না তো? মাঝে মাঝেই নানা সমীক্ষার মাধ্যমে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা অদূর ভবিষ্যতের যে ভয়াল চিত্র তুলে ধরেন, তা যদি যথাযথ গুরুত্বসহকারে বিচার করে দ্রুত সঠিক ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তবে চরম বিপদ থেকে রেহাই মিলবে না। মাংস খাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবীতে যে পরিমাণ গ্রীনহাউজ গ্যাস উৎপন্ন হয়, তার ১৫ শতাংশ আসে পশুপালন খাত থেকে। প্রতিবছর প্রাইভেট কার, ট্রেন, জাহাজ এবং বিমান থেকে যে পরিমাণ দূষণ তৈরি হয়, এই পশুপালন খাত থেকেও একই পরিমাণ গ্রীনহাউজ গ্যাস উৎপন্ন হয়। লন্ডন-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাটাম হাউজ বলছে যদি মাংস খাওয়ার পরিমাণ না কমালে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঠেকানো সম্ভব হবে না। বিশ্ব মাংস খাওয়ার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি আমেরিকায়। সেখানে প্রতিদিন একজন ব্যক্তি গড়ে ২৫০ গ্রাম মাংস খায়। একজন মানুষের স্বাস্থ্যবান হবার জন্য যে পরিমাণ মাংস খাওয়া প্রয়োজন এটি তার চারগুণ। পৃথিবীর অনেক দেশে যেখানে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হচ্ছে সেখানে মাংস খাওয়ার পরিমাণ বাড়ছে। বিশ্বজুড়ে ২০৫০ সাল নাগাদ এই মাংস খাওয়ার পরিমাণ এখনকার চেয়ে ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। যারা বেশি কার্বন নির্গত করছে পৃথিবীর ৭০ ভাগ গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গত করছে মাত্র ১০টি দেশ। এর মধ্যে ২৪ শতাংশ নির্গমন হচ্ছে চীন থেকে, ১২ শতাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এবং ৯ শতাংশ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কার্বন নির্গমন কমানোর জন্য একটি বৈশ্বিক পরিকল্পনা করতে হবে যা প্রতিটি দেশ মানতে বাধ্য থাকবে। এমনি একটি পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার জন্যই এই প্যারিস সম্মেলন। এ ছাড়া আরও একটি বিষয় নিয়ে প্যারিসে সব দেশগুলোর ঐকমত্য হবার প্রয়োজন রয়েছে- তা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য দরিদ্রতর দেশগুলোকে সহায়তা করতে একটি ১০ হাজার কোটি ডলারের তহবিল গঠন করা।
×