ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কাওসার রহমান

শিশু নির্যাতন চুপ করে থাকার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

শিশু নির্যাতন চুপ করে থাকার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। শিশুদের নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণের মতো ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমে খবর হিসেবে প্রকাশিত ও প্রচারিত হচ্ছে। এ নিয়ে সারাদেশে সমালোচনার ঝড় বইছে। সিলেটে শিশু রাজন ও খুলনায় রাকিব হত্যার ঘটনা একটি বীরের জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জাজনক। এগুলো কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো আমাদের বারবার সঙ্কেত দিচ্ছে সমাজে মানবিক অবক্ষয়ের দারুণ অবনতি ঘটছে। গত জানুয়ারি থেকে জুলাই- এই সাত মাসে দেশে ১৯১ শিশু খুন এবং ২৮০ শিশু ধর্ষিত হয়েছে। শুধু জুলাই মাসেই খুন হয়েছে ৩৭ শিশু, ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫০টি। এই চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এটি প্রতিরোধে ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যত চিত্র আরও ভয়াবহ হবে। খুনের সঙ্গে সমানতালে চলছে শিশু ধর্ষণের ঘটনা। ধর্ষণের শিকার হচ্ছে ছেলে শিশুরাও। শিশুরা একশ্রেণীর মানুষের যৌন বিকৃতির টার্গেটে পরিণত হয়েছে। ফলে শিশুদের নির্যাতন বা ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। অথচ বেশিরভাগ শিশু ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের ঘটনা আড়ালে থেকে যাচ্ছে। তবে ছেলে এবং মেয়ের আনুপাতিক হিসাবে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের যৌন নির্যাতনের সংখ্যা বেশি। আগে ছেলেদের ধর্ষণের ঘটনা সীমিত ছিল। বোর্ডিং, স্কুল বা মাদ্রাসায় হতো। এখন সেই ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে। লঞ্চঘাটে, বাস টার্মিনালে কিংবা বিপণি বিতানে যেসব শ্রমজীবী শিশু থাকে কিংবা যারা পথশিশু তারাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের দ্বারাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। তবে সেগুলো চার দেয়ালের বাইরে আসছে না। আইনের প্রয়োগহীনতা বিচারহীনতার কারণেই শিশু নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। দেশে প্রতিনিয়ত শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু তার বিচার হচ্ছে না। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আমরা খুব কমই দেখছি। শিশু নির্যাতনের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এ সব ঘটনার পর রাষ্ট্র ও প্রশাসনের নীরব ভূমিকা অনেক সময় পরোক্ষভাবে এমন ঘটনা আবারও ঘটাতে সহায়তা করছে। আবার একটি নির্যাতনের ঘটনার এত দীর্ঘ সময় পরও বিচারের কাজ সম্পন্ন হচ্ছে না, মানুষের মনে তা প্রভাব সৃষ্টি করতে পারছে না। বাংলাদেশ সরকার শিশু নির্যাতনে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেল এবং এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখে শিশু আইন-২০১৩ প্রণয়ন করেছে। এর পাশাপাশি আইনে শিশু নির্যাতনের নানা অপরাধের বিচারে শিশু আদালত গঠনেরও কথা বলা হয়েছে। এই আইনে শিশুদের প্রতি আঘাত, উৎপীড়ন, অবহেলা, বর্জন, পরিত্যাগ, অশালীনতা প্রদর্শনের কারণে তাদের দুর্ভোগ, স্বাস্থ্য বা মানসিক ক্ষতি হলে তাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া আইনটিতে ১০০টি ধারা রয়েছে এবং শিশুদের উন্নয়ন, বিকাশ, স্বার্থ, অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা এই আইনের প্রয়োগ দেখছি না। এখনও শিশু নির্যাতন বন্ধে শিশু আদালত গঠন করা হয়নি। আইন প্রয়োগে আমরা সরকারের উদাসীনতাই দেখছি। আবার আইন প্রয়োগে আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মাঝেও দ্বৈত নীতি দেখতে পাচ্ছি। বেশিরভাগ শিশুই যারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তারা গরিব ঘরের। ফলে এখানে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে না। ধনী ঘরের শিশুরা নির্যাতনের শিকার হলে সেখানে পুলিশের তৎপরতা দেখা যায়। এর আর্থিক কারণ বাদ দিলেও আরও একটি কারণ আছে, তা হলো প্রভাব। গরিব মানুষ পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। ফলে তাদের শিশুরা নির্যাতনের শিকার হলে তা ধামাচাপা পড়ে যায়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে, ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। কিন্তু এমন অনেক নজির আছে যে, বছরের পর বছর ধরে মামলা চলছে। বিচার প্রক্রিয়া শেষ হচ্ছে না। এ প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে দ্রুত শিশু নির্যাতনের তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম শেষ করতে হবে। এক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকা প্রশংসনীয়। মিডিয়া যে সকল নির্যাতনের ঘটনার পেছনে লেগে থাকে কেবল সেগুলোরই দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। যেটা শিশু রাজন বা রাকিবের ক্ষেত্রে হয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ ধরনের ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে যেমন বিচারহীনতার সংস্কৃতি রয়েছে, তেমনি সামাজিক অবক্ষয়ও কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা তো রয়েছেই। একশ্রেণীর মানুষ শিশুদের ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখছে। এতে অনেক ক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফির প্রভাব রয়েছে। শিশুদের প্রতি কিছু মানুষের এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই ধর্ষণের ঘটনা বাড়াচ্ছে। নানা শ্রেণীর এবং বয়সের ব্যক্তিরা এটি করছে। শিশুদের ওপর বল খাটানো বা প্রভাবিত করা, ভয় দেখানো সহজ হয়। ফলে সেই সুযোগটি নিচ্ছে অপরাধীরা। অনেকে অজ্ঞতার কারণে আদালত বা পুলিশের দোরগোড়ায় পৌঁছাচ্ছেন না। ফলে এসব অপরাধ ঘটছেই। অনেক শিশু বা অভিভাবকই জানে না কোথায় অভিযোগ জানাতে হয়। আর অনেকে দেখছেন অনেক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে; কিন্তু বিচার তো হচ্ছে না। বাইরে মিটমাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। অনেক দেশে এসব অপরাধের দ্রুত বিচার আইনে সাজা হয় এবং মানুষ তা দেখে সচেতন হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সে ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তাই এ ধরনের মামলার বিচারের দীর্ঘসূত্রতা দূর করতে উদ্যোগ নেয়া দরকার। সেইসঙ্গে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে নির্যাতনকারীদের। শিশু ধর্ষণের ব্যাপারে আলাদা সেল ও মামলার গতি তদারকি করা দরকার। তাহলে এ ধরনের অপরাধ অনেকটা কমতে পারে। তাছাড়া প্রতিটি থানায় শিশুদের জন্য পৃথক সাপোর্ট সেন্টার করা যেতে পারে। পাশাপাশি শিশুদের জন্য বিশেষ টেলিফোন নম্বর নির্ধারণ করা যেতে পারে, যেখানে নির্যাতিত শিশু বা তার অভিভাবকরা ফোন করলে পুলিশ দ্রুত এসে ব্যবস্থা নেবে। ধর্ষণ মামলায় সাক্ষ্য আইনের সাহায্য নিতে হয়। বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণের সন্নিবেশ ঘটাতে গিয়ে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়। তাই শিশু ধর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রে আইন সংশোধন করা যেতে পারে, যেখানে শিশু ভিকটিমকে আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে হবে না। চিকিৎসকদের রিপোর্টের ভিত্তিতেই চার্জশিট দেবে পুলিশ। চিকিৎসকদের সঙ্গে মানবাধিকার কর্মীও থাকতে পারেন। শিশু নির্যাতন তথা খুন ও ধর্ষণের মতো ঘটনা প্রতিরোধের জন্য সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির কোন বিকল্প নেই। শুধু আইন প্রয়োগ করে এই নির্মম নৃশংস কর্মকা- বন্ধ করা যাবে না। এটা প্রতিরোধ করতে হলে সবার আগে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমাদের এসব নির্যাতন-অপরাধ দেখে ‘চুপ করে থাকার সংস্কৃতি’ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা চুপ করে থাকি বলেই এসব ঘটনা অপ্রতিরোধ্যভাবে ঘটছে। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারের সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজন সামাজিক প্রতিরোধ শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে রাজনৈতিক দলগুলোরও পক্ষ থেকে কোন ধরনের ভূমিকা দেখা যায় না। রাজনৈতিক দলগুলোর দেশব্যাপী শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। এ নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে রাজনৈতিক দলগুলো সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে। এর বিকল্প হচ্ছে সোস্যাল মিডিয়া। সোস্যাল মিডিয়াই এখন এই সচেতনতা সৃষ্টিতে আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসার স্থল। সেই ভূমিকা তারা পালন করেই চলেছে। তবে এই ভূমিকা শুধু ভার্চুয়াল জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। মাঠে-ঘাটে মানুষকে প্রতিবাদী করে তুলতে হবে। যাতে মানুষ শিশু নির্যাতনের ঘটনা দেখলেই চুপ করে না থেকে প্রতিবাদী হয়। সামাজিক সংগঠনগুলোকেও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সেইসঙ্গে দেশব্যাপী শিশু নির্যাতন বিরোধী ক্যাম্পেইন শুরু করতে হবে। এ ক্যাম্পেইন চলবে সারা বছর ধরে। শুধু নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে গণমাধ্যমে প্রচার পাওয়ার জন্য লোক দেখানো মানববন্ধন করেই তাদের এ দায়িত্ব শেষ করলে চলবে না। এক্ষেত্রে মানবাধিকার কমিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশব্যাপী সারা বছর এ ক্যাম্পেইনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। সর্বোপরি দেশের শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিকদেরই এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে শিক্ষিত সমাজ সচেতন হলেই শিশু নির্যাতন শূন্যের কোটায় চলে আসবে। লেখক : সাংবাদিক
×