ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মমতাজ লতিফ

এই লোক মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসীদের চাবুক মেরেছে!

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ২৫ মে ২০১৫

এই লোক মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসীদের চাবুক মেরেছে!

দেশে অনেক ঘটনা পর পর ঘটে গেল। যা আমাদের মতো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসীদের ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ করেছে। যার মধ্যে একের পর এক প্রগতিশীল ব্লগার যারা আমাদের নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা- তাদের হত্যা, পহেলা বৈশাখে বাঙালীর প্রাণের উৎসবে বাঙালী তরুণীদের বিশেষ মৌলবাদী গোষ্ঠীর পরিকল্পিত নির্যাতন এবং ঐ ঘটনায় দায়ীদের গ্রেফতার দাবি করা তরুণ-তরুণীদের ওপর মৌলবাদী পুলিশের বর্বর হামলা, সবশেষে দেশের একজন বরেণ্য বিজ্ঞানী, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, লেখক জাফর ইকবালের প্রতি জঘন্য অশ্লীল ক্রোধান্ধ আক্রমণ! ড. জাফর ইকবাল বা ড. হুমায়ূন আহমদরা ঘরে ঘরে জন্ম নেয় না, এ কথা এক কিশোর-কিশোরীও জানে। এই ব্যক্তি কি জানে যে একজন হুমায়ূন আহমদ, একজন জাফর ইকবাল রাজনীতিক না হয়েও শুধু লেখক হয়ে, শিক্ষার্থীপ্রিয় শিক্ষক হয়ে লাখ লাখ কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী ভক্ত অনুসারী তৈরি করেছেন। যারা তাঁদের অনুসরণ করে দেশপ্রেমিক হতে শিখেছে, দেশকে, জাতিকে কিছু দেওয়ার কথা ভাবতে শিখেছে! এমনকি, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে নিজেদের গড়ে তোলার শিক্ষাও জাফর ইকবাল এদের দিয়েছেন, যা ভূঁইফোড় চেলা-চামু-া পরিবৃত এবং সর্বোপরি ‘খাই খাই’ রাজনীতিতে বিশ্বাসীরা, রাজনীতিকরা সারাজীবন পাত করেও পারবে না। দেশপ্রেমিক হওয়ার কঠিন ব্রতটি শেখানো অতি কঠিন। শেখা তত কঠিন নয়, যদি তরুণ-তরুণীদের সামনে থাকে কয়েকজন জাফর ইকবালের মতো শিক্ষকÑ এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ, যে দেশটি একটি সশস্র মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ নারী-পুরুষ-শিশুর প্রাণের বিনিময়ে অর্জন করেছিল, যে যুদ্ধে বহু অমূল্য প্রাণ জাতিকে উৎসর্গ করতে হয়েছিল, লাখ লাখ কৃষক-শ্রমিকের পাশে কত শত শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, পুলিশ কর্মকর্তা, সেনা কর্মকর্তা, প্রকৌশলী, রেল কর্মকর্তা, অফিস-পরিচালক পাকিস্তানী বাহিনীর পাশে বাঙালী যুদ্ধাপরাধী, এদেশী দালালদের হাতে নিহত হয়েছিল, আজ সে শোক নতুন করে আমাকে বেদনার্ত করে তুলছে! কেননা মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকার ও দলগুলোকে ’৭১-এর ওই বাঙালীকে নেতৃত্বশূন্য করার আলবদরীয় মর্মন্তুদ হত্যাযজ্ঞ এবং ’৭৫-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারপ্রধান জাতির স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা ও জনক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর চার ঘনিষ্ঠ সহচর জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ড যে অবশ্য পালনীয় শিক্ষা দিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেÑ ১. মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকার আর কখনই তার শত্রু-ধর্মের নামে হত্যাকাণ্ড ঘটানো, জঙ্গী-মৌলবাদী দল ও ব্যক্তিকে চিনতে, রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়ার মতো আত্মঘাতী ভুল করবে না। ২. শত্রুর প্রতি কোনভাবেই এ সরকার নমনীয় হবে না। বরং মুক্তিযুদ্ধের শত্রু দল ও ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত ’৭১-এর, ’৭৫-এর অপরাধ, পরবর্তী ২০০১ থেকে ২০০৬, ২০১৫ সালে সংঘটিত প্রতিটি অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচার করা হবে। আমরা জানি, বিচারহীনতা, সাপের মতো শত্রুদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে এক সাপ অসংখ্য সাপের জন্ম দেয়, যারা তাদের শত্রুকে কখনই ক্ষমা করে না, করবে না। ৩. শত্রুর মিত্রকে কখনও বিশ্বাস করা যাবে না। মানুষ তার নিজস্ব নীতি-বিশ্বাসের ভিত্তিতে মিত্রতা গড়ে তোলে! সুতরাং সেই ’৭১-এ খালেদা পাকি-হানাদারদের সঙ্গে সেনানিবাসে বসবাস করে প্রমাণ করেছিল, সে কাদের মিত্র। তেমনি জিয়া যুদ্ধে যোগ দিলেও ’৭৬-এ ক্ষমতা দখল করেই একের পর এক যুদ্ধাপরাধীর স্বার্থ, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের স্বার্থ রক্ষা করে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং অনায়াসে মুক্তিযোদ্ধা, জীবন রক্ষাকারী কর্নেল তাহের থেকে শুরু করে খালেদ মোশাররফ, হুদা, হায়দারসহ কমপক্ষে চার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে! একই কাজ করেছে তারেক-খালেদা-নিজামী নেতৃত্বাধীন নেতাকর্মীরাও! জোট সরকার ক্ষমতায় আসা মাত্র প্রথমেই আক্রমণ করেছে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও হিন্দু জনগোষ্ঠীকে, পুরোপুরি ’৭১-এর কায়দায়! ওরা ২০১৩, ২০১৫ সালে যে বর্বরতা ও ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করে, তারও শিকার কিন্তু মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকার, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, শ্রমিক, কৃষক যারা আওয়ামী লীগের তৃণমূল শক্তি। ২০১৩ সালে মৌলবাদী জঙ্গীদের যেমন পরিচয় প্রকাশ্য হয়, তেমনি খালেদা-তারেকের জঙ্গী মৌলবাদী চরিত্র ও বিশ্বাস উপরোক্ত অপরাধগুলোতে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। এত বিশাল মাপের অসংখ্য অপরাধের টার্গেট হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকারের ঘরের ভেতর যুদ্ধাপরাধী-পক্ষ ঘাপটি মেরে বসে থাকবে, তা পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য। যে সাংসদ সাংসদ হয়ে জনগণের সেবক হতে জানেন না, জনগণের ওপর প্রভুত্ব করাকে সাংসদের কাজ মনে করেন, সে আর যাই হোক, জনগণের বন্ধু হতে পারে না। সে দলের জন্য বিশাল-ভার! এ ভার আওয়ামী লীগ বহন করবে কেন? জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্য এসব প্রভুত্বকারীকে কারা আওয়ামী লীগের সাংসদ পদ দিতে ভূমিকা রেখেছেন, তাদেরও খুঁজে বের করা দরকার। জাতির মুক্তি, স্বাধীনতা ও উন্নয়নের নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ হারলে, পরাজিত হলে দেশবাসী, জাতি, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হেরে যায়! এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র জয়ের রয়টারকে দেয়া ব্লগার হত্যা প্রসঙ্গে প্রদত্ত মন্তব্যটি আলোচনায় আসতে পারে। সরকার ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করেছে এবং এটি চলমান। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেখা গেছে মুক্তিযুদ্ধপন্থী তরুণ প্রজন্মের ব্লগারদের নেতৃত্বে বাংলাদেশে জয় বাংলার পক্ষে একটি তুমুল আলোড়ন সৃষ্টিকারী গণজাগরণ মঞ্চ সংগঠিত হয়, যা জামায়াত, জামায়াত-মিত্র খালেদা-তারেককে গভীর শঙ্কায় ফেলে দেয়! ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবি, সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি দেশের মৌলবাদী-জঙ্গীবান্ধবদের হিসাব বানচাল করে দেয়! সে সময়ই খালেদা-তারেক-জামায়াত-জঙ্গীবান্ধব সাংবাদিক, জঙ্গীবান্ধব সুশীল সমাজ ’৭১-এর আরেক যুদ্ধাপরাধী দল হেফাজতে ইসলামকে, এর নেতৃবৃন্দকে উস্কানি, অর্থ, নির্দেশ দিয়ে সরকার পতনের নামে দু’দিনব্যাপী এক ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করে! অর্থাৎ সে সময় খালেদা-তারেক গণজাগরণ মঞ্চের বিপরীতে নতুন এই জঙ্গী মৌলবাদী দলকে মাঠে নামাতে সক্ষম হয়, যারা যদি একাধিকবার নামে তাহলে মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকার জনগণকে সুষ্ঠু নিরাপত্তা ও উন্নয়ন দিতে বাধাগ্রস্ত হবে। সম্ভবত এই জঙ্গী দলের মধ্যে স্থিতাবস্থা রাখায় আগ্রহী সরকার। তবে খালেদা-জামায়াত-উগ্র জিহাদীরা বসে নেই। তারা ’৭১-এর বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনক্সার অনুকরণে বর্তমান সময়ের মুক্তিযুদ্ধপন্থী ব্লগারদের তাদের পুরনো নিয়মে ‘কাফের’, ‘মুরতাদ’ ইত্যাদি আখ্যায়িত করে প্রণীত তালিকা ধরে হত্যার মিশনে নেমেছে! এভাবে জঙ্গী আনসারুল্লাহ বর্তমানে ব্লগার হত্যাকারী দল হিসেবে মাঠে আছে, আর এদের চাপাতির আঘাতে আমরা হারিয়েছি মেধাবী, ধর্মনিরপেক্ষ, বিজ্ঞান চর্চাকারী ব্লগার অভিজিত, রাজীব, বাবু, দীপ, অনন্তদের! স্মরণ রাখতে হবে, জামায়াত-শিবির থেকে যেমন একদিন তারেক, খালেদা, জেএমবি, হিযবুত তাহ্্রীর, হরকত-উল-জিহাদ ইত্যাদি খুনী দল গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের মানুষকে হত্যার জন্য লেলিয়ে দিয়েছিল, সেই একই নীতিতেই নতুন আনসারুল্লাহ দল গঠিত হয়েছে, যারা নীতি-আদর্শে যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত-শিবিরের অনুসারী। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীপুত্র বলতে চেয়েছেন যে, সরকারকে খুব সূক্ষ্ম একটি সুতার ওপর অবস্থান করে দেশের, জনগণের, যুদ্ধাপরাধীর বিচার, অপরদিকে জাতির সার্বিক উন্নয়নÑ সবকিছু করতে হচ্ছে। সেজন্য সরকার কৌশলগত কারণে আইনী পথে যাচ্ছে। মুখে ব্লগার হত্যার বিরুদ্ধে জোরালোভাবে কোন বক্তব্য দিচ্ছে না, যদিও আওয়ামী লীগ অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ একটি দল। জয়ের এই বক্তব্য বাস্তবতাকেই ইঙ্গিত করছে। আমরা জানি, প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারকে দেশী-বিদেশী অনেকদিক বিবেচনা করে অনেক চাপকে কৌশলে উপেক্ষা করে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। তবে শেখ হাসিনার সরকার বা তাঁর তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ পুত্র জয় দেশে আবার কোন ধ্বংসযজ্ঞ বা কোন উদাসীনতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে জঙ্গী মৌলবাদীদের উত্থান চান না এতে কোনই সন্দেহ নেই। নতুবা জঙ্গী মৌলবাদীদের হিটলিস্টে শেখ হাসিনা ১ নম্বর হতেন না, বারংবার গুলি-গ্রেনেড-বোমা হামলার তিনি টার্গেট হতেন না! তিনিই তো জঙ্গী মৌলবাদী সব দল ও তাদের মিত্র খালেদা-তারেকের প্রধান শত্রু, এ তো তিনি জানেন, জাতিও জানে! যদিও আশ্চর্য এই, যে অসম্ভব ধর্মপ্রাণ শেখ হাসিনা ধর্মের নামে যারা রাজনীতি করে, তাদের প্রধান মিত্র হওয়ার কথা নয় কি? গোলাপী জর্জেট কেন, কী কারণে ধর্মজীবীদের প্রাণভোমরা হলো প্রকৃতপক্ষে গভীর স্বার্থ, আন্তর্জাতিক জঙ্গীবাদী অপরাজনীতি, ধ্বংসের, হত্যার, অস্ত্রের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত! খালেদা জানেন তিনি যদি মাথায় ওড়না নাও দেন, আঁচল হাতের ওপর দিয়ে ফেলে বিদেশী পুরুষের সঙ্গে দেখা করেন, তাতে তাঁর কোন ক্ষতি হবে না! তাঁকে কেউ ‘কাফের’ ‘মুরতাদ’ আখ্যা দেবে না, বরং তিনি তাদের প্রিয়পাত্রই থাকবেন! তাই তিনি এসব করেও দেখিয়েছেন পাবলিককে। তা দেখে জামায়াত, হেফাজত, আনসারুল্লাহ নেতারা সবাই কি সুন্দর নীরবতা অবলম্বন করেছে! ঐ মহিলা তিন মাস যাবত পেট্রোলবোমা মেরে শত শত নারী-পুরুষ, শিশুকে হত্যা করিয়েও, ইলেকশন থেকে সরে দাঁড়িয়েও এত লাখ লাখ ভোট তাঁর দলের প্রার্থী পেলেন কিভাবে? এই বর্বর অপরাধের পর তো তাঁর প্রার্থীদের শূন্য ভোট পাওয়ার কথা ছিল! কেন বাংলাদেশে ওই জঙ্গীবান্ধবদের এত ভোট হয়Ñ তা জাফর ইকবালসহ আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। সুতরাং দেশকে উন্নয়নের পথে নিতে প্রধানমন্ত্রীকে অনেক অনেক হিসাব কষতে হচ্ছেÑ জয় সেই কথাই বলতে চেয়েছেন। তবে আমাদের শেষ কথাÑ আমরা আমাদের তরুণ ব্লগারদের একের পর এক জঙ্গীদের হাতে মৃত্যুর মুখে দিতে পারি না। সেজন্য পুলিশ-গোয়েন্দারা আন্তরিকভাবে কাজ করলে, হয়ত সেদিন দূরে নয়, যেদিন ওই জঙ্গী খুনীরা যেখানেই থাকুক, গ্রেফতার হয়ে বিচারের মুখোমুখি হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জাতির যুক্তিবাদী, আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ-তরুণীরাই আপনার মুক্তিযোদ্ধা আমাদের শেষ ভরসা, তাদের রক্ষার জন্য যা যা প্রয়োজন তা তা করুন। যুদ্ধাপরাধীর বিচারের মতো অসম্ভব মনে করা কাজটি যিনি করতে সক্ষম, তিনি আমাদের সন্তানদেরও রক্ষা করতে সক্ষমÑ এ বিশ্বাস আমাদের আছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×