
২০২৪ সালের জুলাইয়ে দেশজুড়ে সংঘটিত এক ঐতিহাসিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ মুক্তি পায় দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের কবল থেকে। ছাত্রসমাজ, সাধারণ জনগণ ও দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণে এই আন্দোলন রূপ নেয় এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে। তৎকালীন সরকার-নিয়ন্ত্রিত দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বহু মানুষ প্রশাসনিক চাপ, ভয়ভীতি এবং চাকরি হারানোর আশঙ্কায় সরাসরি আন্দোলনে যুক্ত হতে পারেননি। তবে তাঁদের মধ্যেও কিছু সাহসী মানুষ ছিলেন, যাঁরা সকল বাধা উপেক্ষা করে আন্দোলনের প্রতি সরাসরি সংহতি প্রকাশ করেন। তাঁদের এই অবস্থান আন্দোলনের ন্যায্যতা ও নৈতিক অবস্থানকে আরও মজবুত ভিত্তি দেয়।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়েও (বুটেক্স) ২০২৪ সালের সেই আন্দোলনের সময় এক অনুরূপ চিত্র দেখা যায়। আন্দোলনের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিলেও, শুরুতে তারা শিক্ষকদের পাশে পায়নি। তবে সময়ের প্রবাহে পরিস্থিতি বদলায়। চলমান আন্দোলনের এক পর্যায়ে, প্রশাসনিক চাপ ও নিরাপত্তা-সংক্রান্ত শঙ্কা উপেক্ষা করে বুটেক্সের ১৩ জন নির্ভীক শিক্ষক ৩১ জুলাই ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে অংশ নেন। তাঁরা কেবল ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেননি, বরং চলমান দমন-পীড়ন ও গণহত্যার বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রতিবাদ জানান। শিক্ষার্থীদের কাছে এই পদক্ষেপ হয়ে ওঠে এক সাহসী প্রেরণার উৎস। আজ, কালের পরিক্রমায় এক বছর পর সেই ‘মার্চ ফর জাস্টিস’-এর প্রেক্ষাপট থেকে তাঁদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি বিষয়ে কথা বলেছেন তাঁরা। চলুন শুনি তাঁদের কণ্ঠে সেই অভিজ্ঞতা
ড. শেখ মো. মামুন কবীর
অধ্যাপক, টেক্সটাইল ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
২০২৪ সালের ৩১ জুলাইয়ের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ ছিল ছাত্রসমাজের একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। কোটা বাতিলের আদেশ প্রত্যাহারের প্রতিবাদ থেকে শুরু হয়ে ‘জুলাই গণহত্যা’র পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিই নীরব থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। জানতাম, ঝুঁকি আছে চাকরি হারানো, মামলা, এমনকি গুম হওয়ার আশঙ্কাও ছিল। তবু দাঁড়িয়েছিলাম সত্যের পক্ষে।এক বছর পার হয়ে গেছে। আজ বুটেক্সে অনেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে, এটাই আন্দোলনের প্রকৃত সাফল্য। যদিও অনেক প্রিয় মুখ হারিয়ে গেছে, তবু জানি এই আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না। আমাদের প্রত্যাশা বুটেক্স হোক নৈতিক, মানবিক ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো প্রকৌশলীদের প্রস্তুতিমাঠ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে যেন পারস্পরিক শ্রদ্ধা থাকে। ক্যাম্পাস হোক ভয়মুক্ত, জবাবদিহিমূলক এবং চিন্তার স্বাধীনতায় সমৃদ্ধ। ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ আমাদের শুধু প্রতিবাদ নয়, মানুষ হতে শিখিয়েছে।
ড. মো. সুলতান মাহমুদ
সহযোগী অধ্যাপক, ইয়ার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
আমার স্বাধীনচেতা মন বলে, বিগত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার দেশের মানুষকে কার্যত গোলামে পরিণত করেছিল। ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা, নিরাপত্তা—কোনোটিই ছিল না। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুম, বিচারহীনতা ও দুর্নীতি আমাদের কার্যকর নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নিয়েছিল। হাসিনা সরকারের পাঁচটি প্রধান অপরাধ—ভোটাধিকার হরণ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ধ্বংস এবং দেশবিরোধী আন্তর্জাতিক চুক্তি। এদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া জরুরি।
জুলাইয়ে যখন “বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন” শাসকগোষ্ঠীকে চাপে ফেলে, তখন আমরা ‘মার্চ ফর জাস্টিস’-এ অংশ নিই। ভয় ছিল, তবু আত্মাকে রক্ষা করতে সাহস করি। আল্লাহর কৃপায় আন্দোলন সফল হয়েছে, বিচার চলছে। বুটেক্স প্রশাসনও রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে, যা প্রশংসনীয়। এখন দরকার একাডেমিক এক্সিলেন্স, মেধার মূল্যায়ন, শাসনের জবাবদিহি এবং শূন্য রাজনীতিকরণ। শিক্ষার্থীদের ঐক্য ও শৃঙ্খলা থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় দূষণমুক্ত থাকবে—এই বিশ্বাস আছে।
ইহসান ইলাহি সাবিক
প্রভাষক, হিউম্যানিটিজ অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্স বিভাগ
‘মার্চ ফর জাস্টিস’ ও লাল ফিতা আমার কাছে এক নবজাগরণের প্রতীক। এটি ছিল তারুণ্যের অদম্য স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম, জালিম শক্তির বিরুদ্ধে এক সাহসী ন্যায়যুদ্ধ। এটি ছিল শুধু শাসকদের বিরুদ্ধে নয়, তাদের নীরব সহযোগীদের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ।
আমরা চেয়েছিলাম এক নতুন বাংলাদেশ যেখানে ইনসাফ, কল্যাণ ও মানবিকতা রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে। কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের জন্য দরকার নির্দলীয় প্রশাসন, নৈতিক শিক্ষা, মানবিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা, দুর্নীতিমুক্ত অর্থনীতি ও শক্তিশালী প্রতিরক্ষা। ফ্যাসিবাদের পতন শুরু হয়েছে, বিচার এগোচ্ছে, আপোসহীন নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে। এক আত্মমর্যাদাশীল প্রজন্ম গড়ে উঠছে, যারা আধিপত্যবাদকে চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রস্তুত। এই আশার আলোই তো প্রথম বিজয়।
নুরুন্নেসা অর্পা
সহকারী অধ্যাপক, অ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
‘মার্চ ফর জাস্টিস’ আমাদের অন্যায়কে প্রশ্ন করার সাহস জুগিয়েছে। বুটেক্সে আমরা কণ্ঠ তুলেছিলাম বৈষম্য, রাজনৈতিক দখলদারিত্ব এবং সম্মানের সংকটের বিরুদ্ধে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল একটি সমমর্যাদার শিক্ষাঙ্গন, যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সম্মানের সাথে কাজ করবে।
এক বছরে কিছু পরিবর্তন এসেছে। রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছে, নতুন ব্যাচ ক্লাস শুরু করেছে আশাবাদের বার্তা নিয়ে। তবে অনলাইন-অফলাইনে অপমান, আস্থা সংকট, দমনমূলক আচরণ এখনও বিদ্যমান। আমাদের একটাই চাওয়া ভালো কাজের স্বীকৃতি থাকুক, বৈষম্য না থাকুক, কেউ যেন প্রতিবাদের জন্য হেনস্তার শিকার না হন। স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে, এখন সেটা রক্ষা করার সময়।
তাবাসসুম ফেরদৌস
সহকারী অধ্যাপক, ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
৩১ জুলাইয়ের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’-এ অংশ নেওয়া বিবেকের তাড়না থেকে। রাস্তায় শিক্ষার্থীদের গুলিতে নিহত হতে দেখে চুপ থাকতে পারিনি। জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষকদের লাল ফিতা দেখে অনুপ্রাণিত হই। পরে সুলতান স্যারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা শহীদ মিনারে দাঁড়াই, ভয়কে পাশ কাটিয়ে। ছাত্রলীগের কিছু সদস্য ছবি তুললেও কেউ ভয় পায়নি। মনে হয়েছিল, না থাকলে বিবেকের কাছে দায়ী থাকতাম।
আন্দোলনের পর বুটেক্সে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে পড়াশোনা করতে পারছে। আমার একটাই প্রত্যাশা বুটেক্স রাজনীতি ও বৈষম্যমুক্ত থাকুক, গড়ে উঠুক এক আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে জ্ঞান, গবেষণা ও মানবিকতা হবে মূল চেতনা।
তৌফিকা সিদ্দিকা
সহকারী অধ্যাপক, ইয়ার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
গত জুলাইয়ে অনেকেই চাচ্ছিলেন প্রতিবাদ হোক। পরে সুলতান স্যার উদ্যোগ নেন, আমি ও তনিমা ম্যাম রাজি হই। এরপর সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’-এ অংশ নেন। যদিও সরাসরি চাপ ছিল না, তবুও বুঝতাম আর চুপ থাকা যায় না।
এই প্রতিবাদ শিক্ষকদের দায়বদ্ধতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এখন ক্যাম্পাসে আগের মতো নোংরা রাজনীতি নেই, এটা বড় প্রাপ্তি। ভবিষ্যতে যেন কেউ নিরীহ শিক্ষার্থীকে নির্যাতন না করে এটাই প্রত্যাশা। স্বজনপ্রীতি, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ বজায় থাকুক, যেখানে বুটেক্স পরিবার একসঙ্গে কাজ করবে। আমরা চাই, বিশ্ববিদ্যালয় কেবল প্রযুক্তি নয় ন্যায়, সৌহার্দ্য ও গৌরবের প্রতীক হয়ে উঠুক।
আঁখি