ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০১ আগস্ট ২০২৫, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২

ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে জাতীয় সংকটে নেতৃত্ব দেয়

স্বাধীন বাংলাদেশে দলীয় লেজুড়বৃত্তির ফাঁদে পড়ে ডাকসু

মীর মোহাম্মদ জসিম

প্রকাশিত: ০০:৩১, ১ আগস্ট ২০২৫

স্বাধীন বাংলাদেশে দলীয় লেজুড়বৃত্তির ফাঁদে পড়ে ডাকসু

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)

প্রতিষ্ঠার মাত্র ২ মাসের মাথায় ১৯২১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মুসলিম হল ইউনিয়নের অভিষেকের মাধ্যমে ছাত্র সংসদের যাত্রা শুরু হয় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে। পরে ১৯২২-২৩ সাল থেকে ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (ডাসু) নামে নির্বাচিত ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে নেতৃত্ব নির্বাচন শুরু হয়। 
শিক্ষার্থীদের জনপ্রতি এক টাকা চাঁদার তহবিলে বিতর্ক সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মতো কর্মসূচিগুলো পালন করাই ছিল ডাসুর মূল কাজ। মূলত শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বগুণ বৃদ্ধি করাই ছিল এ সংসদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। 
ধীরে ধীরে এটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায় এবং পরবর্তীতে জাতির ভাগ্য নির্ধারণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় প্রতিষ্ঠানটি। এবং ১৯৫৩-৫৪ সালে ডাসু থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নামে যাত্রা শুরু করে এটি। 
১৯২২ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ৪৮ বছরে ডাকসুর নির্বাচন হয় ২৯ টি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৪ বছরে নির্বাচন হয় মাত্র ৮টি। অথচ ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী, প্রতিবছর ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। 
এমনকি ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে ডাকসুর নেতৃবৃন্দ জাতির সংকটে নেতৃত্ব দিলেও স্বাধীন বাংলাদেশে এটি দলীয় লেজুড়বৃত্তির ফাঁদে পড়ে যায়। 
সর্বশেষ ২০১৯ সালের নির্বাচনেও ডাকসু দলীয় লেজুড়বৃত্তি থেকে বের হতে পারেনি। এমনকি সাধারণ সম্পাদকের ছাত্রত্ব না থাকলেও সে সময় টেম্পারিং করে তাকে ভোটার বানানো হয়। বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন এ কর্মকা-ে সরাসরি জড়িত ছিল। 
তবে এবারের নির্বাচনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত এবং পূর্ণ গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালিত করার দাবি জানিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি প্রতিবছর যাতে নির্বাচন হয়, সেদিকে প্রশাসনকে নজর দিতে হবে। তারা মনে করেন বিগত প্রশাসন যারা নির্বাচন করতে পারেননি, তারা ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ভঙ্গ করেছেন। এজন্য তাদের বিচার হওয়া উচিত। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আব্দুল কাদের জনকণ্ঠকে বলেন, ডাকসু হতে হবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের সুযোগ সুবিধা এবং জাতীয় স্বার্থে দল মতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করবে এমন নেতৃত্ব চাই এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে। ‘আমরা চাই বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করুক। কোনো প্রার্থীর প্রতি যাতে সুনজর না থাকে, সেটাই আমরা প্রত্যাশা করি। শিক্ষার্থীরা যাতে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে, সে পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে প্রশাসনকে।’
ব্রিটিশ আমলে ডাকসুর (ডাসু) ভিপি-জিএস ছিলেন যারা
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলেও ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ডাসু তার যাত্রা শুরু করে। এটির প্রথম ভিপি ছিলেন মমতাজ উদ্দিন আহমেদ এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। 
১৯২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে ২য় নির্বাচিত নেতৃত্বে ছিলেন ভিপি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ এবং জিএস একে মুখার্জি (ভারপ্রাপ্ত এবি রুদ্র), ১৯২৮-২৯ সালে ভিপি হন এএম আজহারুল ইসলাম এবং জিএস এস চক্রবর্তী।
১৯২৯-৩২ শিক্ষাবষের্র ভিপি রমণী কান্ত ভট্টাচার্য এবং জিএস হন কাজী রহমত আলী ও আতাউর রহমান (যৌথভাবে)। ১৯৩২-৩৩ ও ১৯৩৩-৩৪ শিক্ষাবর্ষের জিএস হন ভবেশ চক্রবর্তী; ১৯৩৫-৩৬ ও ১৯৩৬-৩৭ শিক্ষাবর্ষে এএইচএমএ কাদের; ১৯৩৮-৩৯ শিক্ষাবর্ষে আব্দুল আওয়াল খান; ১৯৪১-৪২ শিক্ষাবর্ষে জিএস হন আব্দুর রহিম। এ সময়কালের ভিপির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। 
১৯৪৫-৪৬ শিক্ষাবর্ষের ভিপি আহমদুল কবির (ভারপ্রাপ্ত ফরিদ আহমেদ) এবং জিএস সুধীর দত্ত। ১৯৪৬-৪৭ শিক্ষাবষের্র ভিপি ফরিদ আহমেদ এবং জিএস সুধীর দত্ত, ১৯৪৭-৪৮ শিক্ষাবর্ষের ভিপি অরবিন্দ বোস এবং জিএস হন গোলাম আযম (জামায়াত নেতা)। 
পাকিস্তান আমল  
পাকিস্তান আমলের প্রথম নির্বাচিত ভিপি ছিলেন এসএ বারী এবং জিএস হন জুলমত আলী খান (ভারপ্রাপ্ত ফরিদ আহমেদ) (১৯৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষ)। ১৯৫৪-৫৫ ও ১৯৫৫-৫৬ শিক্ষাবর্ষে ভিপি হন নিরোদ বিহারী নাগ এবং জিএস আব্দুর রব চৌধুরী, ১৯৫৬-৫৭ শিক্ষাবর্ষে ভিপি একরামুল হক এবং জিএস শাহ আলী হোসেন, ১৯৫৭-৫৮ শিক্ষাবর্ষে ভিপি বদরুল আলম এবং জিএস ফজলী হোসেন, ১৯৫৮-৫৯ শিক্ষাবর্ষে ভিপি আবুল হোসেন এবং জিএস এটিএম মেহেদী; ১৯৫৯-৬০ শিক্ষাবর্ষে ভিপি আমিনুল ইসলাম তুলা এবং জিএস আশরাফ উদ্দিন মকবুল; ১৯৬০-৬১ শিক্ষাবর্ষে ভিপি বেগম জাহানারা আক্তার এবং জিএস হন অমূল্য কুমার।
শিক্ষা আন্দোলনের সময় ১৯৬১-৬২ শিক্ষাবর্ষে ভিপি হন এসএম রফিকুল হক এবং জিএস এনায়েতুর রহমান, ১৯৬২-৬৩ শিক্ষাবর্ষে ভিপি শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ এবং জিএস কেএম ওবায়েদুর রহমান, ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে ভিপি রাশেদ খান মেনন এবং জিএস মতিয়া চৌধুরী, ১৯৬৪-৬৫ শিক্ষাবর্ষে ভিপি বোরহানউদ্দিন এবং জিএস আসাফউদ্দৌলা; ১৯৬৬-৬৭ শিক্ষাবর্ষে ভিপি ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী এবং জিএস শফি আহমেদ, ১৯৬৭-৬৮ শিক্ষাবর্ষে ভিপি মাহফুজা খানম এবং জিএস মোরশেদ আলী, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় ১৯৬৮-৬৯ শিক্ষাবর্ষে ভিপি তোফায়েল আহমেদ এবং জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী এবং পাকিস্তান আমলের সর্বশেষ ১৯৭০-৭১ শিক্ষাবর্ষে ভিপি হন আসম আবদুর রব এবং জিএস হন আব্দুল কুদ্দুস মাখন।
আসম আবদুর রব এবং জিএস হন আব্দুল কুদ্দুস মাখনরা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কলা ভবনের বটতলায়। 
স্বাধীন বাংলাদেশে ছিলেন যারা
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ভিপি ছিলেন মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও মাহবুব জামান (১৯৭২-৭৯), ১৯৭৯, ১৯৮০ ও ১৯৮২ সালে ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। প্রথম ২ নির্বাচনে যথাক্রমে জাসদ-ছাত্রলীগের এবং বাসদ-ছাত্রলীগের প্রার্থী হয়ে সহসভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে জিতেছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না ও আখতারুজ্জামান। 
মাহমুদুর রহমান মান্না এবং আখতারুজ্জামান (১৯৭৯-৮০, ১৯৮০-৮১) ভিপি এবং জিএস পদে ২ বার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ডাকসুর ভিপি ছিলেন আখতারুজ্জামান এবং জিএস ছিলেন জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। ১৯৮৯-৯০ শিক্ষাবর্ষে দায়িত্ব পালন করেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ এবং মুশতাক আহমেদ। 
১৯৯০ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষের ভিপি ও জিএস পদে যথাক্রমে নির্বাচিত হন আমানউল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকন। সর্বশেষ ১৯৯০ সালের ৬ জুন নির্বাচনের পর ডাকসুর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে চলে যায়। সর্বশেষ দীর্ঘ ২৮ বছর পর ২০১৯ সালে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ভিপি হিসেবে নির্বাচিত হন নুরুল হক নুর এবং জিএস হন গোলাম রাব্বানী। 
কারা হচ্ছেন ৩৮তম ভিপি, জিএস!
আগামী সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য ডাকসু নির্বাচনে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা হলেন, ছাত্রদলের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবিদুল ইসলাম খান ও বিএম কাওসার এবং কবি জসীমউদ্দীন হল শাখা ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক তানভীর বারী হামিমের নাম আলোচিত হচ্ছে ।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি আবু সাদিক কায়েম ও বর্তমান সভাপতি এস এম ফরহাদ প্রার্থীর আলোচনায় আছে। 
এছাড়া গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার, সদস্যসচিব জাহিদ আহসান ও মুখ্য সংগঠক তাহমিদ আল মুদ্দাসির চৌধুরী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আবদুল কাদের, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মহিউদ্দিন মুজাহিদও আলোচনায় রয়েছেন। 
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু ও বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর জাবির আহমেদ এবং ছাত্র অধিকার পরিষদের বিন ইয়ামিন মোল্লার নামও শোনা যাচ্ছে।
তবে কারা চূড়ান্তভাবে এ নির্বাচনে লড়বেন তা আগামী কিছুদিনের মধ্যে জানা যাবে। দলীয়ভাবে এবং স্বতন্ত্র হয়ে অনেকে নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহে আছেন। কেউ কেউ আবার আগাম নির্বাচনের প্রার্থিতা ঘোষণাও দিয়েছেন। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মহিউদ্দিন মুজাহিদ মাহি অন্যতম।

প্যানেল হু

×