
জরিনা বেগম। বয়স সঠিক কতো জানেন না। তবে অন্তত ২৫ টি বছর ধরে ভিক্ষা করছেন এটি নিশ্চিত করেই জানালেন। স্বামী আবু বকর ২০০৩ সালে মারা গেছেন। ছিলেন অসুস্থ, অচল। তখনও ভিক্ষা করতে হতো জরিনার। এক চোখে দেখতে পায় না। অপরটিতেও অপারেশনের পরে কিছুটা সচল। প্রথম দফায় ২০১৩ সালে এই হতভাগীর সঙ্গে দেখা মেলে এ প্রতিবেদকের। তখন বয়োবৃদ্ধা মা ৯০ বছর বয়সী নুরজাহান ও মেয়ে মিনারাকে নিয়ে কলাপাড়া প্রেসক্লাবে এসে অসহায়ত্বের কথা জানাচ্ছিলেন। জরিনার বাবা মারা গেছেন ৭০ সালের বন্যায়। স্বামী ২০০৩ সালে আর মেয়ে জামাই মিনারার স্বামীও ২০১২ সালে গত হয়েছেন। তখন মা মেয়ে ও নিজে তিন বিধবা একত্রে ভিক্ষা করতেন। সবশেষ আবারো বৃহস্পতিবার রাতে দেখা মেলে অসহায় বৃদ্ধা বিধবা জরিনার সঙ্গে। পটুয়াখালীর পর্যটন সমৃদ্ধ কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের মজিদপুর গ্রামে জরিনাদের ঝুপড়িঘরে আবাসস্থল।
যেন দুঃখের সাতকাহন এদের। সব কিছুতেই মিল ছিল। ফেবিকলের ওই বিজ্ঞাপনের মতো আটকে ছিল এদের বাধন। কিন্তু সেই বাধন সুখের নয়, দুঃখগাঁথা। সম্পর্কে মা-মেয়ে-নাতনি। তিনজনেই হতদরিদ্র। সবাই বিধবা। ভিক্ষেবৃত্তি করছিলেন। তারপরও থেমে ছিল না জীবনযুদ্ধ। যেন যতক্ষণ শ্বাস, তো ততক্ষণ আঁশ-এমনটাই ছিলেন। তিন প্রজন্মের তিনটি পথ যেন জীবনযুদ্ধে এক পথে আটকে ছিল। রাস্তায় রাস্তায়, দ্বারে দ্বারে ভিক্ষে করতেন। কিন্তু জরিনার মা নুরজাহান ও মেয়ে মিনারা মরে গিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে চিরতরে বেঁচে গেছেন। জরিনার জীবীকার লড়াই এখনও থামেনি। বেচে আছে মৃত মিনারার মেয়ে তার নাতনি ফাতেমা। তবে ভিক্ষাবৃত্তি না করলেও অন্যের বাড়িতে দুমুঠো অন্নের জন্য সে কাজ করছে। অসুস্থ, বলতে গেলে কর্মহীন ছেলে বাবুলের সঙ্গে থাকেন। ঘর বলতে এক চালের একটি ঝুপড়ি। ছয় হাত বাই পাঁচ হাত। তাও নাকি আবার জমির বিরোধ রয়েছে।
সরকারের সামাজিক নিরাপত্তার বয়স্কভাতার ছাউনি ছাড়া আর কোন ছায়া মেলেনি জরিনার। অথচ এরাও ভোট দেন নির্বাচনের সময়। পছন্দের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করেন। কিন্তু তাদের পছন্দের ন্যুনতম চাহিদাও অপুর্ণই থেকে যায়। বিধবা, বয়স্ক কিংবা দুঃস্থ কোন সহায়তা এদের কপালে জোটে না।
অনেকের কাছে এখন গল্পের মতো। শোনেনও অনেকে। কিন্তু, ওই পর্যন্ত। রাস্তায়, দ্বারে দ্বারে ভিক্ষে করতে করতে তিন জনের দুই জনের জীবনাবসান ঘটেছে। জরিনাও অপেক্ষা করছেন। খড়কুটার মতো উড়ে যাবে জনপদ থেকে, থমকে যাবে জীবন স্পন্দন। প্রশ্ন থেকে যায়। সরকারিভাবে কার জন্য সামাজিক নিরাপত্তার ছায়া। কাদের জন্য করা হয়েছে আবাসন, আশ্রায়ন কিংবা সবশেষ মুজিব বর্ষের ঘর। যা বিতরণে এসব বাছাই কিংবা বরাদ্দ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত তারা জরিনাদের চেয়ে মনের দিক থেকে আরো বেশি দরিদ্র! তাইতো জরিনাদের অসহায়ত্ব শেষ হয় না। মৃত্যু ছাড়া শেষ হয় না দুঃখ কষ্টের জীবনের শেষটা।
শিহাব