ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫, ১১ শ্রাবণ ১৪৩২

আড়াইশ’ বছরের ঐতিহ্যের নিদর্শন 

ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ 

প্রকাশিত: ২০:৩২, ২৫ জুলাই ২০২৫

ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ 

.

বাংলার বার ভূঁইয়ার অন্যতম ঈশা খাঁর স্মৃতি বিজড়িত ও বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর শিবমন্দিরসহ নানা  বৈচিত্র্যের হাওড় অধ্যুষিত কিশোরগঞ্জ জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক-বাহক ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ। প্রায় আড়াইশ’ বছরের প্রাচীন এ মসজিদটি বর্তমানে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটি জেলা সদরের গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, ২৫০ শয্যা জেনারেল আধুনিক সদর হাসপাতাল ও এককালের খরস্রোতা নরসুন্দা নদীর তীরে শহরের পশ্চিম হারুয়াস্থ এলাকায় অবস্থিত। 
আকাশছোঁয়া সুউচ্চ মিনারে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদের ইমারত অত্যন্ত সুন্দর এবং নির্মাণশৈলীতে চমৎকার বলা চলে। আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই মসজিদটি ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান হিসেবে ইতোমধ্যে সুনাম-খ্যাতি ছড়িয়ে দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছে। মসজিদটি একটি সাধারণ ধর্মীয় স্থাপত্যের কাঠামো অনুসরণ করে নির্মিত প্রধান প্রার্থনা কক্ষ, ছাদের ওপর অর্ধবৃত্তাকার গম্বুজ এবং উঁচু মিনার রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ভূখন্ডের সংস্কৃতি ও ভূপ্রকৃতি বিবেচনায় রেখেই স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়েছে।

সব শ্রেণির মানুষের তীর্থস্থান 
ইতিহাস-ঐতিহ্যের নিদর্শন পাগলা মসজিদটি শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছেই নয়, বরং সকল ধর্মাবলম্বীর কাছেই পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন বয়সি মুসলিম-হিন্দুসহ নানা ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে নারী-পুরুষ মানত নিয়ে ছুটে আসেন এই মসজিদে। অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়েও আসেন ঐতিহাসিক এই স্থাপনা দেখতে। আবার কেউ-বা আসেন মসজিদে দান-খয়রাত করতে। প্রত্যেহ দূর-দূরান্ত থেকে অগণিত মানুষ নগদ টাকা-পয়সা, স্বর্ণালঙ্কার, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, কোরআন শরীফ, মোমবাতি ও আগরবাতি দান করেন। বিশেষ করে প্রতি শুক্রবার এই মসজিদে মানত নিয়ে আসা বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষের যেন ঢল নামে। আগতদের মধ্যে মুসলিমদের অধিকাংশই জুমার নামাজ আদায় করেন এ মসজিদে। তখন অতিরিক্ত মানুষের কারণে ওই অঞ্চলে তীব্র যানজট সৃষ্টির ফলে সাধারণ মানুষকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়।

কেন মানুষ ছুটে আসেন পাগলা মসজিদে 
তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ বিচরণের ফলে পাগলা মসিজদের প্রচার দিন দিনই ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। এতে করে ঐতিহাসিক এই স্থাপনা নিয়ে মানুষের আগ্রহের যেন কমতি নেই। তাই তো মনের বাসনা পূরণসহ আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় প্রতিদিনই হাজারো মানুষ ছুটে আসেন পাগলা মসজিদে। তাছাড়া মুসলিম-অমুসলিম সবাই এ মসজিদে দুই হাত খুলে দান করেন। অনেকের বিশ্বাস, কেউ খাস নিয়তে দান করলে তার মনের ইচ্ছা পূর্ণ হয়। এই বিশ্বাস থেকেই মানুষ এখানে বিপুল পরিমাণ দান-খয়রাত করেন। কারণ, মানুষের বিশ্বাস-একনিষ্ঠ মনে এখানে মানত বা দান করলে রোগ-শোক, বালা-মসিবত দূর হয়। 
দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা এসব মানুষের অনেকে চিঠি ও চিরকুট লিখেও মসজিদের সিন্দুকে ফেলেন। এতে কেউ পরকালে নাজাতের আশায়, কেউ রোগমুক্তি, কেউ পরীক্ষায় ভালো ফল, কেউ সন্তানের আশায়, কেউ পারিবারিক শান্তির আশায় আবার কেউ-বা রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠার ইচ্ছের অভিব্যাপ্তি প্রকাশ করেন। 
সর্ববৃহৎ আয়কারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান 

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আয়কারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাগলা মসজিদের সুনাম-খ্যাতি রয়েছে। এই মসজিদের দানবাক্সে দৈনিক প্রায় লাখ টাকা জমা পড়ে। এখানে দেশ-বিদেশের মানুষেরা দান-খয়রাত করতে আসেন। অনেকে মানি অর্ডারের মাধ্যমেও টাকা পাঠান। 
আর যাদের দানের সামর্থ্য নেই, তারা মনে করেন এখানে এসে দানের পরিবর্তে নফল নামাজ আদায় করলেও মনোবাসনা পূর্ণ হয়। শুধু মুসলমান নন, অন্য ধর্মের মানুষও এখানে দান করেন। 
প্রায় তিন মাস পরপর মসজিদের ৯টি দানবাক্স খুললেই পাওয়া যায় নগদ কয়েক কোটি টাকা। দিন যত যাচ্ছে ততই যেন এ দানের পরিমাণ বাড়ছে। এছাড়া পাওয়া যায়-স্বর্ণালংকার-রূপা, বৈদেশিক মুদ্রা ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী। এর বাইরে অনেকে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রও দান করেন। 
সেগুলো প্রতিদিন আসরের নামাজের পর খোলা ডাকে বিক্রি করা হয়। এতে যেই পরিমাণ টাকা পাওয়া যায়, সেগুলো আবার তফসিলি ব্যাংকে জমা রাখা হয়। আর সিন্দুকে দানের জমাকৃত টাকা কয়েকশ’ লোকের দিনভর গণনার এলাহী কা- দেখতে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা শ্রেণি পেশার হাজারো মানুষ ছুটে আসেন মসজিদে।
তবে পাগলা মসজিদে দানের বিষয়ে আলেমদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র মতামত। কেউ বলেন, মসজিদে দান করা নেকির কাজ; তবে শুধু এই মসজিদে দান করলেই মনোবাসনা পূর্ণ হবে- এমন ধারণা ইসলাম পরিপন্থি নয়। আবার কেউ মনে করেন, এমন বিশ্বাস শরীয়তবিরোধী এবং কুসংস্কার। তাদের মতে, দানের নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়া উচিত এবং তা হওয়া উচিত কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।

পাগলা মসজিদের ইতিকথা 
মসজিদের ইতিহাস সম্পর্কে প্রচলিত রয়েছে প্রায় ৫০০ বছর আগে ঈশা খাঁর আমলে ‘দেওয়ান জিলকদর খান ওরফে জিল কদর পাগলা’ নামে এক আধ্যাত্মিক পাগল সাধকের বাস ছিল শহরের হারুয়া ও রাকুয়াইল এলাকার মাঝপথে প্রবাহিত নরসুন্দা নদীর মধ্যবর্তী স্থানে জেগে ওঠা উঁচু টিলাকৃতির স্থানটিতে। তিনি সেখানে মাদুর পেতে বসে নামাজ পড়তেন। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান নির্বিশেষে সব লোকজনের যাতায়াত ছিল ওই সাধকের আস্তানায়। ওই পাগল সাধকের দেহাবসানের পর তার উপাসনালয়টিকে কামেল পাগল পীরের মসজিদ হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন এলাকাবাসী। পরে জিলকদর পাগলার নামানুসারেই ‘পাগলা মসজিদ’ নামে পরিচিতি পায়। বর্তমানে আশ্চর্যজনকভাবে এখানে দেশের দূর-দূরান্তের এমনকি দেশ-বিদেশের লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকে। আর এই ধারাবাহিকতা চলছে আড়াইশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে।
অন্য একটি মতে, জেলা শহরের হয়বত নগরের জমিদার দেওয়ান জিলকদর খান ওরফে জিল কদর পাগলা নামক এক আধ্যাত্মিক ব্যক্তি এখানে নামাজ পড়তেন। পরবর্তীতে তাঁর নামানুসারে মসজিদের নাম হয় ‘পাগলা মসজিদ’। আরও একটি মতো অনুযায়ী, পাগলা বিবি নামের এক জমিদার বংশীয় নারীর নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ হয়ে থাকতে পারে। 

মসজিদের আয়তন ও বর্তমান নাম 
পাগলা মসজিদের জমির পরিমাণ ৩ একর ৮৮ শতাংশ। প্রথমে ১০ শতাংশ জমির ওপর মসজিদটি গড়ে উঠেছিল। যা হয়বতনগর দেওয়ান বাড়ির ওয়াকফকৃত। জেলা শহরের পশ্চিম হারুয়াস্থ নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত মসজিদটির বর্তমান নাম হচ্ছে ‘পাগলা মসজিদ ও ইসলামিক কমপ্লেক্স’। এটি বর্তমানে তিনতলা বিশিষ্ট, ছাদে রয়েছে ৩টি গম্বুজ ও পাঁচতলা ভবনের সমান একটি মিনার। এটি কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে অন্যতম নিদর্শন। এখানে একসঙ্গে প্রায় ৬ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। নারী-পুরুষের জন্য রয়েছে পৃথক নামাজের ব্যবস্থা।
সময়ের বিবর্তনে আজ পাগলা মসজিদের পরিধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে এর খ্যাতি ও ঐতিহাসিক মূল্য। অনেক বছর আগে মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে কিংবদন্তি আছে মসজিদটি গায়েবিভাবে নির্মিত হয়েছে। মসজিদকে কেন্দ্র করে এখানে একটি অত্যাধুনিক ধর্মীয় কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সম্প্রসারিত হয়েছে মূল মসজিদ ভবনও। 
তবুও দিন দিন মুসল্লিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থান সংকুলান হচ্ছে না। মসজিদটি এখন প্রায় চার একর জায়গাজুড়ে রয়েছে। তাছাড়া মসজিদের পশ্চিম পাশেই রয়েছে একটি সামাজিক গোরস্তান। 

যেভাবে পরিচালনা হয় মসজিদ 
ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদটি একসময় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত কমিটি দিয়ে পরিচালনা করা হতো। তখন মসজিদের আয়-ব্যয়ের হিসাবও স্বাভাবিক নিয়মেই পরিচালনা করা হতো। মসজিদের অবকাঠামো উন্নয়ন আর খতিব-ইমাম, মুয়াজ্জিন-খাদেমদের বেতন-ভাতাদি ব্যয় নির্বাহ করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য। সময়ের বিবর্তনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর মিডিয়ার কল্যাণে দিন দিন মসজিদটির সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়লে এখানে দানের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আস্তে আস্তে মসজিদের কলেবরও বৃদ্ধি পায়। 
পাগলা মসজিদটি ১৯৯৭ সাল থেকে ওয়াকফের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। তখন থেকে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে মসজিদের সিন্দুক খুলে টাকা গণনা শুরু হয়। বর্তমানে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে গঠিত কমিটি মসজিদের আয়-ব্যয় নিরীক্ষা করা হয়। দেশের অন্যতম আয়কারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত এ মসজিদের আয় দিয়ে ইতোমধ্যে একটি কমপ্লক্সে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মসজিদটিকে ঘিরে চলছে ব্যাপক উন্নয়নযজ্ঞ। 
এ বিষয়ে পাগলা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান গণমাধ্যমকে জানান, পাগলা মসজিদকে একটি অন্যতম আধুনিক ইসলামিক স্থাপত্য হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যার নামকরণ হবে ‘পাগলা মসজিদ ও ইসলামিক কমপ্লেক্স’। দ্রুতই এর কাজ শুরু হবে। এটি নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা। এটি বাস্তবায়িত হলে মসজিদ কমপ্লেক্স আরও দৃষ্টিনন্দন হবে। যেখানে ৬০ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন।


ঘরে বসে অনলাইনেও মসজিদে দান 

বিভিন্ন প্রতারক চক্র অনলাইন ব্যাংকিং প্রযুক্তির মাধ্যমে পাগলা মসজিদের মানতকারীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিত। এছাড়া দূরের বহু মানুষকে কষ্ট করে এসে মানতের টাকা দিতে হতো। 
আবার দেশ-বিদেশের অনেকের পক্ষে মানত পৌঁছে দেওয়া সম্ভবও হতো না। মানত গ্রহণের নামে প্রতারণা ঠেকাতে ও মানতকারীদের ভোগান্তির অবসানে চলতি বছরের ৪ জুলাই পাগলা মসজিদের ডোনেশন ওয়োবসাইটের (www. paglamosque.or) উদ্বোধন করা হয়। 
ওইদিন পাগলা মসজিদ ও ইসলামিক কমপ্লেক্সের সভাপতি জেলা প্রশাসক অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে বিকাশ ব্যবহার করে পাগলা মসজিদে ৫ হাজার ৪শ’ টাকা দান করে এ কার্যক্রমের সূচনা করেন। 

কীভাবে ব্যয় হয় দানের টাকা 

পাগলা মসজিদ ও ইসলামী কমপ্লেক্সের খরচ চালিয়ে দানের বাকি টাকা স্থানীয় পূবালী ব্যাংক শাখায় জমা রাখা হয়। এ থেকে মসজিদের ইসলামী কমপ্লেক্সের উন্নয়ন, কমপ্লেক্সে অবস্থিত মসজিদ-মাদরাসা, এতিমখানার ইমাম-খতিব-মুয়াজ্জিন, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন প্রদানে ব্যয় করা হয়। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন মসজিদ-মাদরাসা ও এতিমখানায় অনুদানসহ সমাজের অসহায় ও জটিল রোগে আক্রান্তদের সহায়তাও করা হয়। 


মাজহার মান্না
 নিজস্ব সংবাদদাতা, 
দৈনিক জনকণ্ঠ, কিশোরগঞ্জ

প্যানেল

×