ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২

প্রতিদিন একটু করে বিলীন, পদ্মা পাড়ের জীবনযুদ্ধ

মোছাঃ রোকেয়া সুলতানা, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, রাজশাহী কলেজ

প্রকাশিত: ১১:৩৫, ১৮ জুলাই ২০২৫

প্রতিদিন একটু করে বিলীন, পদ্মা পাড়ের জীবনযুদ্ধ

ছবি: জনকণ্ঠ

বাংলাদেশের মানচিত্রে পদ্মা মানে শুধু একটি নদী নয়, এ এক চলমান ইতিহাস, জীবন্ত ঐতিহ্য, আর প্রকৃতির বিশাল আবেগ। কিন্তু এই নদীই আজ হয়ে উঠেছে ভয়াল এক মুখচ্ছবি। প্রতিদিন একটু একটু করে গিলে ফেলছে ঘরবাড়ি, কৃষিজমি, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দির, বাজার একটি জনপদের অস্তিত্বই মুছে দিচ্ছে যেন ধীরে ধীরে। অথচ এই তীব্র বিপর্যয় দেশের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নেই, উঠে আসে না জাতীয় শিরোনামে।

পদ্মা বাংলাদেশের অন্যতম গতিশীল ও অস্থির প্রকৃতির নদী। এর প্রবাহপথ বারবার বাঁক নেয়, স্রোতের তীব্রতা হঠাৎ বেড়ে যায়, এবং তলদেশের ক্ষয়ের হার অস্বাভাবিক। ফলে, নদীতীরবর্তী এলাকা প্রতিনিয়তই পড়ছে ভাঙনের মুখে। একটি ঘর বিলীন হওয়ার অর্থ কেবল চার দেয়াল হারানো নয়, এ হলো স্মৃতি, নিরাপত্তা, এবং ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা হারানো।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত ৫০ বছরে পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়েছে প্রায় ৬৬ হাজার হেক্টর ভূমি, যা প্রায় পুরো ঢাকা শহরের সমান। শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, কুষ্টিয়া, মাদারীপুর ও পাবনার মতো জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। প্রতিটি বর্ষা মৌসুমে নতুন করে শুরু হয় নদীর ধারে বসবাসকারীদের আতঙ্ক, কে জানে কার ঘরটা এবার ভেসে যাবে!

নদীভাঙন শুধু জমি-ঘর হারানোর গল্প নয়, এটি এক গভীর মানবিক সংকট। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। বাস্তুচ্যুত হয়ে তারা ঠাঁই নেয় বাঁধের পাড়ে, শহরের বস্তিতে, কিংবা অস্থায়ী চরে। এই স্থানচ্যুতি ধ্বংস করে দেয় তাদের সামাজিক বন্ধন, শিক্ষাজীবন, স্বাস্থ্যসেবা, এবং অর্থনৈতিক স্থিতি।

প্রভাব পড়ে শিক্ষায়। স্কুল, মাদ্রাসা কিংবা কলেজ কিছুই নিরাপদ নয়। প্রতিবছর অন্তত ১০-১৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরাসরি নদীগর্ভে হারিয়ে যায় বা অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়। শিশুরা বিদ্যালয়চ্যুত হয়, শিক্ষাজীবন থেমে যায় অনিশ্চয়তার ঘূর্ণিতে। একইভাবে ভাঙনের কবলে পড়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ক্লিনিক, ফলে প্রাথমিক চিকিৎসা হয়ে পড়ে দুর্লভ বিশেষ করে নারীদের জন্য।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও পদ্মা পাড়ের জীবন এক অবিরাম সংগ্রাম। এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ কৃষিনির্ভর। একের পর এক জমি নদীতে তলিয়ে যাওয়ায় তাদের প্রধান জীবিকা হারায়। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, নদীভাঙনের ফলে প্রায় ৮৪ শতাংশ কৃষক পরিবার আয়ের প্রধান উৎস হারায়। কৃষকের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় জেলে, কুলিরা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, এবং খেটে খাওয়া শ্রমজীবীরা—তাদের অনেকেই বাধ্য হয়ে শহরমুখী হন, যুক্ত হন নতুন রকমের নগর দরিদ্রতার চক্রে।

সরকারিভাবে পদ্মার ভাঙন রোধে নেওয়া হচ্ছে নানা প্রকল্প। জিও ব্যাগ ফেলা, ব্লক বসানো, বাঁধ নির্মাণ এসব প্রকল্পে প্রতি বছর বরাদ্দ হয় কোটি কোটি টাকা। একাধিক ধাপে প্রায় ১৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘পদ্মা তীর সংরক্ষণ প্রকল্প’ বাস্তবায়নও হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই উদ্যোগ অনেক সময়েই অস্থায়ী, এলোমেলো ও দুর্নীতিগ্রস্ত। সমস্যা চিহ্নিত হওয়ার পর পদক্ষেপ আসে বিলম্বে, প্রকল্প বাস্তবায়নে দেখা যায় দখলদারি, অদক্ষতা, এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এই ভাঙন শুধু মানুষের ঘরবাড়ি নয়, নদীতীরের প্রতিবেশ ও পরিবেশকেও ধ্বংস করছে। গাছপালা হারিয়ে যাচ্ছে, মাছের প্রজনন ক্ষেত্র ভেঙে পড়ছে, জলজ জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পথে। চরাঞ্চলের গরু-মহিষ, পাখি ও অন্যান্য প্রাণী বাসস্থান হারিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে অন্যত্র। এই ধ্বংস তাই কেবল মানবিক নয়, এক গভীর পরিবেশগত বিপর্যয়ও।

বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরার মতো দুর্যোগ নিয়ে যতটা পরিকল্পনা ও আলোচনার ঝড় ওঠে, নদীভাঙন নিয়ে তেমনটা হয় না। অথচ এর ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কম কিছু নয়বরং এটি দীর্ঘস্থায়ী ও বহুমাত্রিক। বিশেষজ্ঞরা একে বলেন "স্লো-অনসেট ডিজাস্টার" অর্থাৎ এমন এক দুর্যোগ, যা হঠাৎ নয়, ধীরে ধীরে জীবনের ভিত কাঁপিয়ে তোলে। কিন্তু এই ধীরে ধীরে ধ্বংস চোখে পড়ে না দ্রুতগতির রাজনীতি বা প্রকল্পনির্ভর প্রশাসনের।

নদীভাঙনের এই চক্র থামাতে হলে দরকার সমন্বিত পরিকল্পনা নদী শাসনের দীর্ঘমেয়াদি প্রকৌশল পরিকল্পনা, ভূমি ব্যবস্থাপনার পুনর্গঠন, নদীতীরবাসীদের পূনর্বাসন ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ কাজ কেবল বরাদ্দ দিয়ে নয়, দরকার আন্তরিকতা ও স্থায়ী রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

পদ্মা পাড়ে বসবাসকারী মানুষদের প্রতিদিন কাটে এক অনিশ্চয়তার প্রহর গুনে আজ হয়তো বেঁচে গেলাম, কিন্তু কাল? সেই প্রশ্নের উত্তর নেই কারও কাছে। নদীর ঢেউয়ের গর্জনে মিশে থাকে হাজারো মানুষের দীর্ঘশ্বাস, প্রার্থনা ও আশাহীনতা।

এই জনপদ কেবল ভূমি হারায় না হারায় সম্ভাবনা, স্মৃতি ও ভবিষ্যতের ভরসা। আর সেই হারানোর গল্প প্রতিদিন একটু একটু করে গড়ে তোলে এক নীরব যুদ্ধের ইতিহাস যার নাম পদ্মা পাড়ের জীবনযুদ্ধ।

মুমু ২

আরো পড়ুন  

×