ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫, ৩১ আষাঢ় ১৪৩২

লালমনিরহাটে

ভূমিহীনদের তালিকায় বিত্তশালীদের নাম, বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ

জামাল বাদশা, লালমনিরহাট

প্রকাশিত: ১৩:৩৭, ১৫ জুলাই ২০২৫

ভূমিহীনদের তালিকায় বিত্তশালীদের নাম, বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ

ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ।

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের পূর্ব ভেলাবাড়ী পুরান ভেলাবাড়ি গুচ্ছগ্রামে ভূমিহীনদের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি ঘর প্রভাবশালী ও বিত্তবানদের দখলে চলে গেছে এমন অভিযোগে উত্তাল এলাকাবাসী। অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা ফজলে এলাহীসহ ঘর নির্মাণ ও প্রাপ্তির তালিকা তৈরিতে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঘর বরাদ্দে ভয়াবহ অনিয়ম হয়েছে।

সরেজমিনে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের ওই দুই এলাকায় পুরোনো ব্যারাক ভেঙে মোট ৫২টি আধা-পাকা ঘর নির্মাণ করে সরকার। এর মধ্যে পুরান ভেলাবাড়ি এলাকায় ৪৬টি ও পূর্বভেলাবাড়ী কামারপাড়ায় ৬টি ঘর নির্মিত হয়। নিয়ম ছিল পূর্বে যারা ব্যারাকে বসবাস করতেন এবং প্রকৃত ভূমিহীন, তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঘর দেওয়া হবে।

কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দা ও ভূমিহীনরা অভিযোগ করছেন, বরাদ্দের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছেন বিত্তশালী ফজর আলী, আজাহার আলী ও হোসেন আলীর মতো ব্যক্তিরা। প্রভাবশালী ফজর আলী ও তার পরিবারের ৮০ শতাংশ, বাজারে দোকান রয়েছে। বিত্তশালী আজহার আলীর রয়েছে বাজারসংলগ্ন ১৭ শতাংশ জমিতে বাড়ি, বাজারে ৪টি দোকান, কৃষিজমি ও মোটা অংকের অর্থসম্পদ। আর হোসেন আলীর বিশাল বাড়ি, ব্যবসা থাকার পাশাপাশি ছেলেও থাকেন বিদেশে।

এই তিনজনই এলাকাবাসীর মতে, সম্পদশালী এবং বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য নয়। অথচ এদেরই নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে পূর্বভেলাবারীর ভূমিহীন দাবিদার ও ব্যারাকের বাসিন্দা ৭জন  ভুক্তভোগী গত ১০ জুলাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগও জমা দেন। অভিযোগপত্রে তারা উল্লেখ করে বলেন, “আমরা প্রকৃত ভূমিহীন, অথচ যাদের জমি-বাড়ি-ব্যবসা সব আছে, তারা ঘর পেয়েছে। আমরা তহশিলদার ও তৎকালীন ইউএনওর কাছে বারবার গিয়েও ঘর পাইনি।” লিখিত অভিযোগে সাক্ষর করেন শেফালী, আবুল, মনছুর, মো. কাসেম, হালিমা, বিউটি ও নাইরুল। 

আশ্রয়ণ ঘর নির্মাণের পূর্বে ব্যারাকের ১ নম্বর ঘরে দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে বসবাস করে আসছিলেন ষাটোর্ধ্ব শেফালী বেগম। তার স্বামী আজিজ হোসেন মারা গেছেন ১৭ বছর আগে। তিনি বলেন, “আমি প্রতিবন্ধী মানুষ। ২৬ বছর ধরে সরকারি ঘরে থাকি। এখন নতুন করে ঘর বানানো হলো। আমাকে কিছু না জানিয়ে আমার ঘরটাই দিয়ে দেওয়া হলো বিত্তশালী ফজর আলীকে। কোথায় যাব আমি?”

তৎকালীন সমবায় কর্মকর্তা ফজলে এলাহীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন পূর্ব ভেলাবাড়ির লাইলী বেগম (৩৫) নামের একজন ভূমিহীন নারী। তিনি বলেন, “আমি ভূমিহীন। কাজ করে খাই। একাধিকবার ঘরের আবেদন করেছিলাম। এলাহী সাহেব ঘর দেওয়ার নাম করে টাকা চাইছিলেন। টাকা না থাকায় আমি ঘর পাইনি। অথচ যারা ৮০ শতাংশ জমির মালিক তারাও ঘর পেল”।একই এলাকার ভূমিহীন আলমাস (৫০) বলেন,  “আমার জমি নেই। সব কাগজপত্র আছে। তৎকালীন ইউএনওর কাছে ঘরের জন্য বারবার গিয়েছিলাম। কিন্তু পাইনি। এটা কষ্টের, অপমানের। শুধু যারা ধনী তারা ঘর পেল!”

বরাদ্দ পাওয়া বিত্তশালীদের পরিবারের সদস্যরাও বরাদ্দের সত্যতা স্বীকার করেছেন। আজাহার আলীর ছেলে শাহআলম বলেন, “আমার বাবা আগে ভূমিহীন ছিলেন। এখন ভাইয়েরা মিলে বাজারে দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করি। জমি কিনে বাড়ি করেছি। কিন্তু ব্যারাকে আমরা ছিলাম, সেই হিসেবেই ঘর বরাদ্দ পেয়েছি। কাউকে টাকা দিইনি।” আর ফজর আলীর ছেলে মমিনুর বলেন, “জমি আছে, দোকান আছে তা সত্য। তবে ব্যারাকে আমাদের ঘর ছিল। তাই হয়তো পেয়েছি। কিন্তু কাউকে ঘুষ দিইনি।” হোসেন আলী কিংবা তার পরিবারের বক্তব্য পাওয়া না গেলেও ছেলে বিদেশে থাকেন তা নিশ্চিত হওয়া গেছে স্থানীয়দের বরাতে। 

এদিকে স্থানীয় সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, সম্প্রতি পূর্ব ভেলাবাড়ী ৬ টি ঘরের চাবি বিতরণে বরাদ্দ পাওয়া বিত্তশালীদের ঘরের চাবি হস্তান্তরের দিন ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) তোপের মুখে পড়ে চাবি না দিয়েই এলাকা ছাড়েন। নিয়মের তোয়াক্কা না করে, পয়সা ও প্রভাব খাটিয়ে যাদের নাম তালিকায় এসেছে তাদের ঘর বাতিল করে প্রকৃত ভূমিহীনদের ঘর দেওয়া উচিত। স্থানীয় রিপন মিয়া ও শাহীন আলম বলেন, প্রকৃত ভূমিহীনরা এসব ঘরের হকদার। দ্রুতই তদন্ত করে বিত্তশালীদের নাম বাতিল করে ভূমিহীনদের মাঝে ঘর বিতরণের ব্যবস্থা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।

ভূমিহীনদের নিকট অর্থদাবি করার বিষয় তৎকালীন সমবায় কর্মকর্তা ফজলে এলাহি তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ, তালিকা প্রস্তুতসহ সার্বিক কাজ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার(ভূৃমি) ও তহশিলদার করেছেন আমি শুধু মনিটরিং করেছি। আর পূর্ব ভেলাবাড়ীর বিতরণ তালিকা বর্তমান কর্মকর্তারা করেছে। তিনি বলেন,  আমার নিকট এখনো ভেলাবাড়ী, নামুড়ির মানুষজন আসে। আমি তাদের উপকার করেছি।

এসব বিষয়ে আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিধান কান্তি রায় বলেন, “আমি তিন মাস আগে এখানে যোগ দিয়েছি। আগের ইউএনও’র সময়ে তালিকা হয়েছে। তালিকায় ব্যারাকের পূর্বের বাসিন্দাদের নাম ছিল। সেই অনুসারেই ঘর বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। তবে অভিযোগ যেহেতু উঠেছে, আমরা যারা ঘর পেয়েছেন তাদের ডেকে যাচাই-বাছাই করব। তিনি জানান, “পূর্ব মেলা বাড়িতে ৪৬টি ও কামারপাড়ায় ৬টি মিলিয়ে মোট ৫২টি আধা-পাকা ঘর নির্মাণ হয়েছে। যারা পুরাতন ব্যারাকে ছিলেন, তারা অগ্রাধিকার পাবে। যারা বাদ পড়বে, তাদের ঘর অন্যত্র বরাদ্দ দেওয়া হবে। আর অনিয়ম প্রসঙ্গে ইউএনও বলেন, ঘর বিতরণের তালিকা প্রস্তুতের বিষয়ে তহশিলদার, এসিল্যান্ড কিংবা অন্য কেউ অনৈতিক সুবিধা নিয়ে থাকলে বা তাদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেলে জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিষয়টি দেখবেন এবং তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিবেন।

মিরাজ খান

×