
কমলগঞ্জ হাসপাতালের বারান্দায় পড়ে থাকা অজ্ঞাত নারীকে উদ্ধার করে ভর্তি করালেন সামাজিক সংগঠন হৃদয়ে কমলগঞ্জ ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা। লীলা বাউড়ী সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন, নিজের রক্তে তাকে বড় করেছিলেন,আজ সেই মা পড়ে ছিলেন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বারান্দায়, ধুলা-ময়লা, পোকা-মাকড় আর অবহেলায়।
গত ১১ জুন রাতে কে বা কারা তাকে কমলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ফেলে রেখে চলে যায়, এরপর দীর্ঘ ২৪ দিন রোদ-বৃষ্টি আর অমানবিক কষ্টে বারান্দার এক কোনায় লীলা বাঁচার লড়াই চালিয়ে গেছেন। হাঁটতে পারেন না, দাঁড়াতেও পারেন না, যেখানে শুয়ে ছিলেন, সেখানেই মল-মূত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হতেন। খাবারের জন্য হাসপাতালে আগত রোগীদের অভিভাবকদের দিকে চেয়ে থাকতেন, কেউ কলা দিত, কেউ পাউরুটি, কেউ এক কাপ চা। তবু বাঁচার আকুতি ছিল চোখে মুখে।
এই নারীর কষ্টের কথা নজরে পড়ে" হৃদয়ে কমলগঞ্জ "এর সিনিয়র স্বেচ্ছাসেবক মো. সাইদুল ইসলাম ও সাংবাদিক আব্দুল মালিকের। এরপর শুরু হয় এক মানবিক সংগ্রাম চোখের পানি ফেলে পরিচয়হীন এই মা’কে বাঁচানোর লড়াই।
অনলাইনে ছবি পোস্ট করে, পরিচয় জানার জন্য মাঠে-ঘাটে খোঁজে বেড়িয়েছেন তারা। পাশে এসে দাঁড়ান সমাজকর্মী মো. জুলফিকার আলী সোয়েব, যিনি শিক্ষক হিসেবেই সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ। কিন্তু এত চেষ্টা করেও খুঁজে পাওয়া যায়নি তার ছেলে রঞ্জিত বাউড়ি বা স্বজনদের।
তখনও হাল ছাড়েননি সাইদুল ইসলাম। প্রতিদিন দোকান থেকে খাবার এনে খাইয়ে দিয়েছেন। গভীর রাতে এসে কয়েল জ্বালিয়ে দিয়েছেন, বৃষ্টির দিনে ভিজে গেছেন তার পাশেই বসে থেকে, যেন একা না লাগে তাঁকে। সেই বারান্দায়, যেখানে কেউ দাঁড়াতে চায় না, সেখানে বসে থেকেছেন এই যুবক, যেন এক সন্তান হারিয়ে যাওয়া মায়ের পাশে ছায়া হয়ে থাকে।
গোপালনগর জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন মাওলানা শাহিন আহমেদ শিপনও পাশে এসে দাঁড়ান নিজ হাতে ধুয়ে দিয়েছেন লীলার গা, গোসল করিয়ে দিয়েছেন, পরিষ্কার করেছেন সেই জায়গা, যেখানে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
৪ জুলাই বিকালে মানবডার ডাকে সাড়া দেন ডা. এস. কে. নাহিদ, ইবনে সিনা হাসপাতালের শিশু, চর্ম ও নাক-কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি লীলাকে দেখে প্রাথমিক চিকিৎসার নির্দেশনা দেন, বলেন তাকে দ্রুত ভর্তি করতে হবে।
পরে শনিবার( ৫ জুলাই) সকাল ১০টায় "হৃদয়ে কমলগঞ্জ "সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ইয়াকুব আলী হোয়াটসঅ্যাপে একটি মানবিক গ্রুপ তৈরি করেন। সেই গ্রুপে সকল স্বেচ্ছাসেবীদের আলোচনা ও উদ্যোগে লীলাকে গোসল করিয়ে, কাপড় পরিয়ে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করানো হয়।এই উদ্যোগে সহযোগীতায় ছিলেন, নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) কমলগঞ্জ শাখার সভাপতি আব্দুস সালাম, হৃদয়ে কমলগঞ্জের সদস্য সোলায়মান উদ্দিন, সাংবাদিক আব্দুল মালিক, হৃদয়ে কমলগঞ্জের সদস্য সোহান আহমেদ, বাবলু আহমেদ, জাবেদ আহমেদ, আল আমিন, কামাল আহমেদ, জয়ন্ত দেব ও সিপার উদ্দিন।
মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, "মানবতা আমাদের শিখিয়েছে দায়িত্ব নিতে, আজ এই মা যেন আবার একটু মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারেন, সেটাই আমাদের চাওয়া। কিন্তু এখন আরেকটি চ্যালেঞ্জ,তার চিকিৎসা, ও সার্বক্ষণিক দেখাশোনার জন্য একজন নারী সহকারীর ব্যবস্থা করা,আমরা একা পারছি না, আমাদের পাশে দাঁড়ান।
কমলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: মাহবুবুল আলম ভূঁইয়া বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে তার খোঁজ রাখছি। হাসপাতালের সকল স্টাফদের বলেছি যেন প্রয়োজন হলে আমাকে অবহিত করে।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাখন চন্দ্র সূত্রধর বলেন,আমরা তার পরিবারের খোঁজে কাজ করছি, পাশাপাশি সমাজসেবা অধিদপ্তরকে জানিয়েছি যেন প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করা যায়।
নুসরাত