ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

কনটেন্ট ক্রিয়েটরের নেশায় যুব সমাজের অবক্ষয়

সাফিজল হক তানভীর, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, শেরপুর

প্রকাশিত: ০০:০৬, ৩ জুলাই ২০২৫

কনটেন্ট ক্রিয়েটরের নেশায় যুব সমাজের অবক্ষয়

ছবি: প্রতীকী

শেরপুরে দিন দিন নতুন এক সামাজিক ব্যাধি উদ্বেগজনকভাবে বিস্তার লাভ করছে। জেলার বহু তরুণ এখন লেখাপড়া ও পেশাগত কাজকর্ম বাদ দিয়ে কনটেন্ট ক্রিয়েটর হওয়ার নামে মোবাইলে ভিডিও তৈরিতে মগ্ন। তাদের প্রধান লক্ষ্য টিকটক, ফেসবুক রিল কিংবা ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করে ভাইরাল হওয়া এবং সর্বোচ্চ ভিউ পাওয়া। এই ভিউ নির্ভর মানসিকতা থেকে তৈরি হচ্ছে এক ধরনের আসক্তি, যা তরুণদের সুশিক্ষা ও সুস্থ চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

আগে যারা কলেজ ও মাদ্রাসায় মনোযোগ দিয়ে সময় দিত, এখন তারা দিনের বড় একটি অংশ কাটায় মোবাইল হাতে ভিডিও বানিয়ে। শহরের রাস্তা, বাজার, পার্ক, এমনকি শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সামনেও তাদের নানা অঙ্গভঙ্গিতে নাটকীয় কিংবা অশালীন কনটেন্ট তৈরি করতে দেখা যায়।

শুধু তাই নয়, অনেকেই আবার ভুয়া খবর বানিয়ে ভাইরাল হওয়ার চেষ্টা করছে। যেমন—“বাঘ ধরা পড়েছে”, “ভূতের বাড়ি”, কিংবা “অলৌকিক ঘটনা”—এই ধরনের শিরোনামে নানা গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এসব কনটেন্ট শুধু সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তই করছে না, বরং সমাজে এক ধরনের অসুস্থ সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে।

শেরপুর সদরের বাসিন্দা ইউসুফ মিয়া বলেন, "যুব সমাজ এখন ভয়াবহ কনটেন্ট-আসক্তিতে আক্রান্ত। আগে ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনার কথা ভাবত, এখন ভাবে কে কত ভিউ পাবে। লজ্জা-শরম যেন আর নেই। মেইন রাস্তা, স্কুল-কলেজ এমনকি হাসপাতালের সামনেও দাঁড়িয়ে নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করে ভিডিও বানায়। ছোটরা দেখে বড়দের মতো করতে চায়। এতে সমাজে নৈতিক অবক্ষয় বাড়ছে। কেউ কিছু বললে উল্টো গালাগালি করে। বলে, ‘তুই জানিস না আমি কনটেন্ট ক্রিয়েটর!’ এটা কি কোনো পরিচয়? এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।"

শ্রীবরদী উপজেলার এক অভিভাবক রিমা খাতুন জানান, "আমার ছেলে এখন আর ঠিকমতো স্কুলে যায় না। সারাক্ষণ ভিডিও বানানো আর টিকটকে পড়ে থাকে। আগে সে ভালো ছাত্র ছিল। এখন পড়াশোনায় মন নেই। এটা নিয়ে আমি খুবই দুশ্চিন্তায় আছি।"

সদর উপজেলার শিক্ষক মেহেদী হাসান বলেন, "আমাদের ছাত্ররা এখন ক্লাসে মনোযোগ দেয় না। তারা ভাবে, কনটেন্ট বানিয়েই বড়লোক হবে। অথচ এই প্রবণতা তাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিচ্ছে। আমরা যদি সামাজিকভাবে এই কনটেন্ট-নেশা প্রতিহত না করি, তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। অবশ্য সব কনটেন্ট খারাপ নয়। কেউ কেউ শিক্ষামূলক, সামাজিক সচেতনতা কিংবা উদ্যোক্তা বিষয়ক ভিডিও তৈরি করছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে তারা ভুল পথে যাচ্ছে।"

সামাজিক সচেতন নাগরিক মিজানুর রহমান বলেন, "এইসব ভিডিওতে শুধু অশ্লীলতা আর হাস্যরস থাকে। ধর্ম, সমাজ ও পরিবারকে নিয়েও তামাশা করা হয়। এসব বন্ধ না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভয়ংকর এক সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত হবে। এখনই সরকার ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। পরিবার, শিক্ষক ও প্রশাসনকে একযোগে কাজ করতে হবে।"

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা সৃষ্টি। পরিবারকে হতে হবে সবচেয়ে বড় শিক্ষার স্থান। শিক্ষকরা শুধু পাঠ্যপুস্তক নয়, নৈতিকতা ও প্রযুক্তি ব্যবহারের সঠিক দিক নিয়েও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ করবেন। প্রশাসনের উচিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি বাড়ানো এবং অশালীন ও বিভ্রান্তিকর কনটেন্টের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ। পাশাপাশি স্কুল ও কলেজে নিয়মিত সচেতনতামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা উচিত।

শহীদ

×