
"আগে নেশা করায় পথে ঘাটে মানুষের হাতে মার খেয়েছি। কপাল, মাথা, হাত-পা ফাটিয়ে দিয়েছে। পরে নাটোর রিহ্যাব সেন্টারে আসার পর রনি ও সাগর ভাই আমাকে সাহায্য করেছেন। পরিচালক শাওন ভাই আমাকে নিজের ছেলের মতোই দেখেন। ভালোভাবে বাঁচতে হবে, কারণ ভালো মানুষের দাম আছে, খারাপের কোনো দাম নেই।"—এভাবেই নিজের জীবনের কথা বলছিলেন নাটোর শহরের মেথরপট্টির বাপ-মা হারা তরুণ সজল।
তিনি আরও বলেন, "এখানে এসে নেশা ছাড়তে পেরেছি। নিজেকে অনেক বদলাতে পেরেছি।"
নাহিদ সারওয়ার নামে আরও একজন তরুণ বলেন, "নাটোর রিহ্যাব সেন্টার আমার জীবনে সুস্থতার একটি ভিত্তি। দীর্ঘদিনের মাদকাসক্ত জীবনে আমি পুরোপুরি অগোছালো ছিলাম। এখানে তিন মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর এখন আমি সুস্থ। জীবনে অনেক স্বপ্ন দেখি। ভালো কিছু করার ইচ্ছা আছে।"
এভাবেই শত শত মাদকাসক্ত তরুণকে নিরাময় ও পুনর্বাসনের কাজ করছে ‘নাটোর রিহ্যাব সেন্টার’। ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা এই সেবাধর্মী নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা ও সেবা গ্রহণ করে অনেকেই সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন এবং নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন।
নাটোর শহরের বড়হরিশপুরে ঢাকা-নাটোর মহাসড়কের পাশে হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির পশ্চিমে অবস্থিত রিহ্যাব সেন্টারটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালে। এটির পেছনে রয়েছে একটি অনুপ্রেরণাদায়ী গল্প। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম সুলতান আহমেদের ছেলে মো. আল আমিন শাওন নিজেই এক সময় মাদকাসক্ত ছিলেন। বাবা তাকে জেলার বাইরে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তোলেন। এরপর জেলার অসংখ্য তরুণ যাতে নিজের জেলায় থেকেই চিকিৎসা নিতে পারে, সেই লক্ষ্যেই তিনি গড়ে তোলেন ‘নাটোর রিহ্যাব সেন্টার’।
রিহ্যাব সেন্টার সূত্রে জানা যায়, শুরুতে মাত্র ৮–১০ জন মাদকাসক্ত নিয়ে যাত্রা শুরু হয়। আজ পর্যন্ত এখানে চিকিৎসা নিয়েছেন ৭৮০ জন, এর মধ্যে প্রায় ৫৫০ জন সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। রিপোর্ট প্রস্তুতকালীন সময়ে এখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন ২২ জন, ফলোআপে রয়েছেন ১৩–১৫ জন। শাওন নিজে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হওয়ায় সুস্থ হওয়া যুবকদের তিনি নিজের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ করে দেন।
রিহ্যাব সেন্টারে রয়েছে ১৬ কক্ষবিশিষ্ট একটি ভাড়া করা ভবন। এখানে মাদকাসক্তদের কাউন্সেলিং, মেডিটেশন, থেরাপি, নামাজ, প্রার্থনা, বিনোদনসহ রুটিনমাফিক কর্মসূচির মাধ্যমে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। এখানে ৮ জন কর্মী এবং ২ জন চুক্তিভিত্তিক চিকিৎসক (একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও একজন খণ্ডকালীন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ) দায়িত্ব পালন করেন।
রিহ্যাব ইনচার্জ মো. আলিম সরকার রনি ও আনোয়ার হোসেন জানান, মাসিক খরচ প্রায় ২ লাখ টাকা। যার বড় অংশ আসে পরিচালক আল আমিন শাওনের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে। রোগীর পরিবারের কাছ থেকে যে সামান্য অর্থ পাওয়া যায়, তা দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব নয়। তাই সমাজের বিত্তবান ও সংশ্লিষ্টদের সহায়তার আহ্বান জানান তারা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, নাটোরের উপপরিচালক মো. মেহেদী হাসান বলেন, “নিয়মিত আবেদনের ভিত্তিতে অনুদান দেওয়া হয়, তবে সেটি খুব সীমিত। জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে আবেদন করলে আমরা তা যথাযথ কর্তৃপক্ষে পাঠাতে পারি।”
জেলা প্রশাসক আসমা শাহীন জানান, “সরকারি সংস্থা না হলে এ ধরনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সরাসরি আর্থিক অনুদানের সুযোগ নেই। তবে কীভাবে সহযোগিতা করা যায়, তা খতিয়ে দেখা হবে।”
সজিব