
ছবিঃ সংগৃহীত
এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘনঘোর বরিষায়’। বাংলা কবিতায় মতো এভাবেই বৃষ্টিস্নাত সজীবতার রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে বর্ষা। রূপময় ঋতু বর্ষার যেন মেঘবতী জলের দিন। ষড়ঋতুর এ দেশে আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষা ঋতু।
কিন্তু দিন দিন প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে চিরচেনা বর্ষার স্মারক কদম ফুল।
আদিকাল থেকে কদম ফুল প্রকৃতির শোভা বর্ধন করে আসছে। কদম ফুল ছাড়া বর্ষা যেন একেবারে বেমানান। বর্ষার অনুভূতি ও অপরূপ সৌন্দর্যের দাবিদার কদম ফুল। বর্ষাকালের বাহারি ফুলের রানী কদম ফুল। কদম ফুলের সৌন্দর্য্যে বিমোহিত হন না এমন বেরসিক মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। বর্ষায় প্রেমিকার মনোরঞ্জনে কদমের জুড়ি নেই। একই সাথে বর্ষার প্রকৃতি বাংলা সাহিত্যে এনে দিয়েছে স্নিগ্ধতা। বর্ষার উপহার সোনা রঙের কদম ফুল নিয়ে রচিত হয়েছে নানা গল্প, উপন্যাস, কবিতা আর গান। মানব কল্যাণে প্রকৃতির সৃষ্টি অসংখ্য ছোট-বড় মাঝারি বৃক্ষরাজির অংশ বিশেষ ফুলের মধ্যে।
বর্ষার মেঘের সঙ্গে মিতালি বলেই এর আরেক নাম মেঘাগমপ্রিয়। আর নারীর সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনা করে অনেকেই বলে ললনাপ্রিয়। এ ছাড়াও স্থান কাল পাত্র ভেদে বিভিন্ন নামেও কদমের পরিচিতি রয়েছে। ভিন্নতার ছোঁয়াতে কদম হয়ে উঠেছে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য। আষাঢ়ে বাদলের দিনে আগমন ঘটেছে হৃদ্মোহিনী কদম ফুলের। তাই তো বৃষ্টির অবিরাম বর্ষণের সঙ্গে সহসাই ভেসে আসে কদম ফুলের রেণুর মিষ্টি সুবাস। কদম আর বর্ষা একে অপরকে আলিঙ্গন করে রয়েছে বহুকাল ধরে। কদম ছাড়া বর্ষা যেন একেবারেই বেমানান। এ জন্য কদম ফুলকে বলা হয় বর্ষার দূত। বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে সামনের সড়কগুলোতে লাগানো হতো কদম গাছ। গ্রামীণ মেঠোপথ সুগন্ধি ছড়ানো কদম ফুল আজ বিলুপ্তির পথে।
কদম ফুল দেখতে বলের মতো গোলাকার। কদমের একটি পূর্ণ মঞ্জরীকে সাধারণত একটি ফুল মনে করা হলেও এটি অজস্র ফুলের সমাহার। এর একটি মঞ্জরীতে প্রায় আট হাজার ফুল বিন্যস্ত থাকে। কদম ফুল দেখতে বলের মতো গোল, মাংসল পুষ্পাধারে অজস্র সরু সরু ফুলের বিকীর্ণ বিন্যাস।
প্রাচীন সাহিত্যের একটি বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে কদম ফুলের আধিপত্য। মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যেও কদম ফুলের সৌরভমাখা রাধা-কৃষ্ণের বিরহগাথা রয়েছে। ভগবত গীতাতেও রয়েছে কদম ফুলের সরব উপস্থিতি। কদম ফুল শুধু বর্ষায় প্রকৃতির হাসি নয়, এর রয়েছে নানা উপকারিতা। কদম গাছের ছাল জ্বরের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে কদম ফুল তরকারি হিসেবে রান্না করেও খাওযা হয়। কদম গাছের কাঠ দিয়ে দিয়াশলাই তৈরি করা হয়ে থাকে।
বর্ষার বাতাসে ভেসে আসা কদমের গন্ধ মনকে আকুল করে তোলে। বর্ণে, গন্ধে এ গাছটি বাঙালির খুব প্রিয়। কদমের অন্যান্য নাম- নীপ, মেঘাগমপ্রিয়, কর্ণপূরক, ভৃঙ্গবলণ্ডভ, মঞ্জুকেশিনী, পুলকি, ললনাপ্রিয়, সুরভি, সিন্ধুপুষ্প ইত্যাদি। আমাদের ঐতিহ্য ও সাহিত্যে কদম গাছ ও ফুল ২ হাজার বছরের পুরোনো।
কদম গাছের আদি নিবাস বাংলাদেশ, ভারত ও চীন। কদম হলুদ, সোনালি বা লাল রংয়ের হয়। লাল কদম দুর্লভ। কদম সমান্তরাল শাখাযুক্ত বড় আকারের পত্রঝরা বৃক্ষ। কদম ফুল গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Neolamarckia cadamba, এটি Rubiaceae পরিবারের সদস্য। কাণ্ড সোজা, শাখা-প্রশাখা ছড়ানো। গাছ ১৮ মিটার উঁচু হয়। নিবিড় পত্রবিন্যাসের জন্য কদম ছায়াঘন। শীতে কদমের পাতা ঝরে এবং বসন্তে কচি পাতা গজায়। সাধারণত পরিণত পাতার চেয়ে কচি পাতা অনেকটা বড়। কদমের কচি পাতার রং হালকা সবুজ। বাকল ধূসর। পাতা সরল, হূৎপিণ্ড আকৃতির, লম্বাটে, বড় আকারের, ডিম্বাকার, চকচকে এবং উজ্জ্বল সবুজ। পাতা ১৫ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। জুন থেকে আগস্ট মাসে ফুল ফোটে। ফুল ক্ষুদ্রাকার, সবুজাভ হলুদ, সুগন্ধি।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাচীনকাল থেকেই ঘরোয়া উপায়ে কদম গাছের ব্যবহার হয়ে আসছে। ভেষজ ঔষধিগুণে ভরপুর কদম গাছ। বিবিধ রোগ প্রতিরোধে কার্যকর। কদম গাছের পাতা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য আশীর্বাদের চেয়ে কম নয়! বিশেষ করে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের মোকাবিলায় সহায়ক। এর ব্যবহারে শরীরে ইনসুলিনের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে থাকে। যার ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা ঠিক থাকে।
কদমের পাতা ও ছাল ব্যথানাশক। কদমের ছাল জ্বরের ওষুধ হিসেবেও উপকারী। প্রচলিত লোকজ ব্যবহারে কৃমি ও ব্যথা সারাতে কদমের বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্রে পায়ের তালু জ্বলা, ব্রণসৃষ্ট ক্ষত ও গ্রন্থিস্ফীতি ইত্যাদি রোগে কদমের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। একশিরা রোগে কদমের ছাল কেটে বর্ধিত স্থানে কদমপাতা দিয়ে বেঁধে রাখলে উপকার পাওয়া যায়।
মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে কদমফুল পানিতে সেদ্ধ করে সে পানি দিয়ে কয়েকবার কুলি করলে সেরে যায়।
শিশুদের কৃমি সারাতে কদমপাতার গুঁড়া পরিমাণমতো খাওয়ালে উপকার পাওয়া যায়। শিশুদের মুখের ঘা সারাতে কদমপাতার সেদ্ধ পানি মুখে ধারণ করলে অতিদ্রুত ঘা সেরে যায়। এসব ছাড়াও কদমের বাকল জ্বরে উপকারী, পাতার রস ছোদের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার্য।
কয়েক বছর আগেও আষাঢ়ের কদম গাছ ফুলে ফুলে ভরে থাকত। কদম ফুলের নয়নাভিরাম দৃশ্য ফুল পিপাসুদের তৃপ্তি মিটাতো। বাঙালির ভালোবাসার কদম ফুল এখন প্রকৃতিতে দেখা মেলে খুব কম। ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে এই অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতীক কদমগাছ। লাভের অঙ্কের হিসাব মেলাতে মানুষ আর বাড়ির আঙিনায় কদম ফুলের গাছ লাগাতে চায় না। মেহগনি, রেইন্ট্রিসহসহ বিভিন্ন দামি কাঠের গাছ রোপণে ঝুঁকছে। প্রকৃতির ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে অন্য গাছের পাশাপাশি কদম গাছ রোপণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। কদম গাছ কমে যাওয়ায় এখন মানুষ তার ঐতিহ্য ভুলতে বসেছে। এমনকি কালের বিবর্তনে কদম ফুল গাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
আলীম