ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ৩১ মে ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ঐতিহ্যের পতন: শ্যামনগরে অস্তাচলে মৃৎশিল্প, জীবিকার টানে পেশা বদল

এবিএম কাইয়ুম রাজ, সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ১৬:০৮, ২৯ মে ২০২৫

ঐতিহ্যের পতন: শ্যামনগরে অস্তাচলে মৃৎশিল্প, জীবিকার টানে পেশা বদল

দৈনিক জনকণ্ঠ

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কুমোরপাড়ায় থেমে গেছে চাকার ঘূর্ণন। মাটির তৈজসপত্র তৈরির যে শব্দ এক সময় প্রাণবন্ত করে তুলত এই জনপদ, আজ তা নিস্তব্ধ। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে শত বছরের পুরোনো এক শিল্প মৃৎশিল্প।

আধুনিক প্রযুক্তি, পরিবর্তিত রুচি ও বাজারের নতুন চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে না পেরে একের পর এক মৃৎশিল্পী পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছেন। কখনো যা ছিল ঐতিহ্যের প্রতীক, এখন তা শুধুই স্মৃতি।

এক সময় কৈখালী, নুরনগর, কাশিমাড়ী, নওয়াবে চর, খানপুর ও শংকরকাটি এলাকায় প্রতিটি পরিবার মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। দিনরাত পরিশ্রম করে তৈরি হতো হাঁড়ি, পাতিল, কলস, দইয়ের পাতিল, খেলনা ও ফুলের টব। ঘরের আঙিনায় চরকা ঘুরত অবিরাম, আর সেই ঘূর্ণনের সঙ্গেই চলত জীবনযুদ্ধ।

কিন্তু আজ সে দৃশ্য আর দেখা যায় না। আধুনিক প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম ও সিলভারের সহজলভ্যতা ও দীর্ঘস্থায়ীত্বের কাছে হার মেনেছে মাটির তৈরি পণ্য। বাজারে চাহিদা নেই বললেই চলে। দামও তুলনামূলকভাবে অনেক কম, অথচ কাঁচামাল মাটি ও লাকড়ির দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। ফলে মৃৎশিল্পীরা পড়েছেন দারুণ স্কটও।

নুরনগর গ্রামের প্রবীণ মৃৎশিল্পী রাধা পাল বলেন, “আগের মতো মাটির জিনিসের চাহিদা নেই। দাম কম, লাভ নেই, অথচ খরচ অনেক বেড়েছে। চরকা ঘুরিয়ে হাঁড়ি-পাতিল বানানোর আনন্দ এখন শুধুই অতীত।”

লিপিকা পালও দীর্ঘ ২৫-৩০ বছর মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। তিনি বলেন, “এই শিল্পে অনেক মায়া আছে। আমরা ছোটবেলা থেকে যা শিখেছি, এখন তা ছেড়ে দিতে হচ্ছে। সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়েই আমি ও আমার স্বামী অন্য কাজের খোঁজ করছি।”

এই পেশা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন অনেকেই। অজিত পাল আসলে ছিল পেশাদার মৃৎশিল্পী। এখন তিনি মোটর গ্যারেজে কাজ করেন। তিনি বলেন, “আগে ভালোই চলত, মানুষ মাটির হাঁড়ি-পাতিল কিনত। এখন কেউ আর এগুলো ব্যবহার করে না। তাই পরিবার চালাতে পেশা বদল করতে হয়েছে।”

হরিপাল নামে একজন মৃৎশিল্পী এখন মোবাইল ফ্লেক্সিলোড ও বিকাশের দোকান চালান। তিনি বলেন, “প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের দাম কম, ব্যবহারে সুবিধা, তাই মানুষ সেদিকেই ঝুঁকছে। আমরা তো বাঁচার তাগিদেই অন্য কিছু করছি।”

স্থানীয়দের ভাষ্য, এক সময় এই শিল্প শুধু জীবিকার উৎস ছিল না, ছিল সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মাটির তৈজসপত্রের ব্যবহার ছিল আবশ্যিক। কিন্তু আজ তা শুধুই স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই শিল্প রক্ষায় সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। প্রশিক্ষণ, সহজ ঋণ সুবিধা ও বাজার সম্প্রসারণের উদ্যোগ না নিলে মৃৎশিল্প অচিরেই হারিয়ে যাবে। নতুন প্রজন্ম পাবে না তাদের শিকড়ের সঙ্গে সংযোগের এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

শ্যামনগরের মানুষ আজও আশা করেন, যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হলে আবারও চরকা ঘুরবে, মাটির হাঁড়ি-পাতিলের ছন্দে মুখর হবে কুমোরপাড়া। কিন্তু সে আশার আলো ক্রমেই ম্লান হয়ে আসছে। এখনই উদ্যোগ না নিলে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প হয়ত অচিরেই হারিয়ে যাবে ইতিহাসের অতলে।

হ্যাপী

×