
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার দেবীপুর ইউনিয়নের শ্রীনগর গ্রামে এক সময় প্রত্যেক সকাল শুরু হতো বাঁশ ছিঁড়ে মুর্তা বুননের রকমারি শব্দে। গ্রামের নারীরা গর্জন করে বুনত হাতে মসৃণ শীতলপাটি—যা শুধু জীবিকার উৎসই নয়, এক প্রজন্মের গর্ববোধও ছিল। আজ সেই শব্দ নিস্তব্ধ; গেল দশ বছরে গ্রামজুড়ে শুধু স্মৃতি রয়ে গেছে।
স্থানীয় প্রবীণ রমেশ চন্দ্র বর্মণ (৭২) বলেন, “আমার বয়স যখন ত্রিশ–চারো বছর, তখন প্রতিদিন এ গ্রাম থেকে ঢাকাসহ অনেক জায়গায় পাটি পাঠাতাম। হাটে গেলে এক হাঁটু পাটি পাওয়া যেত। এখন কিন্তু হাতে গোনা কয়েকজনই এই কাজ চালায়। বাঁশ আর মুর্তা মেলেনা সহজে, আর বাজারমূল্যও চলে যায় ঠিক সময়ে পৌঁছানোর আগেই। ফলে তরুণদের কেউই এমনে ঝুঁকি নিতে চায় না।”
রমেশ বাবার কথায় স্পষ্ট হয়, শুধু শৈল্পিক মনোনিবেশ নয়, আর্থিক অনিশ্চয়তাও দমিয়ে দিয়েছে এই পেশাকে। বাঁশ আর মুর্তা সংগ্রহে পরিবহন খরচ বাড়ার সাথে সাথে পাটির ক্রেতাও হ্রাস পাচ্ছে। তার ফল—স্মৃতিতে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামের ঐতিহ্য।
শ্রীনগরের যুবতী রেশমা বর্মণ (২৩) বলেন,“আমি মায়ের কাছে শিখেছি বুনন, কিন্তু গায়ে সময় নেই। মোবাইল, ইন্টারনেট, নগরের কাজ—সবকিছুই এখন সামনে। বাড়িতে পাটি বুনলে ঘণ্টা কাটে, কিন্তু টাকা পাওয়া যায় না। ভিখারি পেশাতেও কেউ পাত্তাই দেয় না। তাই বাধ্য হয়ে অন্য কাজ করতে হয়েছে।”
রেশমার মত আরও অনেকে পেশাটির প্রতিকূলতা বরণ করে মাঠ ছেড়েছেন। তার ভিড়ে গ্রামেজুড়ে এখন মাত্র পাঁচ–ছয়টি পরিবার পাটি বুনে জীবিকা নির্বাহ করে।
একসময় শ্রীনগরের পাটি ঠাকুরগাঁও শহরের কাঁচাবাজার ছাড়িয়ে পাশের জেলাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ত। নদী-নদী পেরিয়ে গ্রামীণ মাঠে–মাড়িয়ে বিক্রি হত গ্রাম-ব্যস্ততার গর্ব। অথচ আজ সেই জায়গায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সস্তা প্লাস্টিকের মাদুর, যা দেখতে পায়-গিলে টিকলেও ধাঁচ ছড়াতে পারে না কারুকার্যের কোমলতাকে।
স্থানীয় গ্রামপ্রধান মঈন উদ্দিন বলেন,“সাম্প্রতিক দশ বছরে শীতলপাটির চাহিদা প্রায় শেষ—সরকারি কোনো প্রশিক্ষণ কিংবা আর্থিক সহায়তা না থাকায় নতুন প্রজন্ম হাতা তুলেছে। বাজারজাতকরণ করতে পারত, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিক্রি করত, তাহলে শীতলপাটি এখনো বেঁচে থাকতে পারত।”
গ্রামের প্রবীণদের দাবি, যদি সরকারি–বেসরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হয়ে ন্যায্য মূল্য নিশ্চয়তা ও ডিজিটাল বিপণনের দিকনির্দেশনা পাওয়া যেত, তাহলে এখনো প্রজন্মের হৃদয়ে জিইয়ে থাকত শীতলপাটির নরম আঁচড়।
শীতলপাটি শুধু পাটি নয়, শ্রীনগর গ্রামের নারীদের কারুকার্য, সংস্কৃতির এক অনকরা অধ্যায়। তাদের হাতের কাজ ছিল গ্রামের মুখ্য পরিচয়—যা আজ নিঃশব্দ হয়ে মুছে যাওয়ার পথে। সময়মতো যদি পদক্ষেপ নেওয়া না যায়, আগামী প্রজন্ম হয়তো শীতলপাটির কথা শুধু গ্রন্থভাগে পড়বে, আর বাস্তবের মাটিতে আর আর্তনাদ শুনতে পাওয়া যাবে না।
শীতলপাটি হারিয়ে যাচ্ছে শুধু একটি পেশা নয়, হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ নারীদের স্বপ্ন। এখনই দরকার সঠিক দিকনির্দেশনা, আর্থিক সহায়তা ও বাজারজাতকরণের সুযোগ—নইলে শ্রীনগরের ঐতিহ্য চিরতরে নিস্তব্ধ হয়ে যাবে।
রাজু