
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলা। গ্রামের নাম উত্তর বড়ভিটা। উপজেলা সদর থেকে এ গ্রামটি ৪ কি.মি. দূরে। এ গ্রামে বাস করেন স্কুল শিক্ষক তউহিদুল ইসলাম সরকার। তিনি শুধুই স্কুল শিক্ষকই নন। তিনি শিশুসাহিত্যিক, গীতিকার ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠক। পল্লির ধুলো-মাটিতে প্রগতিশীল এই স্কুল শিক্ষক গড়েছেন লেখক জাদুঘর ও পাঠাগার। জাদুঘরে ঠাঁই হয়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মূল্যবান দলিল। আর পাঠাগারে রয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশি বই। স্কুল শিক্ষকের জাদুঘর ও পাঠাগার সমাদৃত সর্বমহলে।
জানা গেছে, প্রগতিশীল এই স্কুল শিক্ষক ২০১০ সালে উপজেলার শাহবাজার হাটের পাশে নিজের অর্থে কেনা ২ শতাংশ জমিতে রংধনু পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। এ পাঠাগারে বইপড়ার অনুকূল পরিবেশ না পেয়ে পুনরায় ২০১৪ সালে নিজবাড়ির পাশে ২ শতাংশ জমির উপর নিজ নামে আরেকটি পাঠাগার স্থাপন করেন। এ পাঠাগারে পাশ্ববর্তী স্কুলগামী শত শত শিক্ষার্থীকে তিনি বইমুখী করেছেন। প্রতি সপ্তাহে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দেন। বইয়ের সাথে দেন চকলেট, কলম ও খাতা।
বছর শেষে সেরাপাঠক পুরস্কার। পাঠাগারটিতে বইয়ের সংখ্যা এখন পাঁচ হাজারের বেশি। তথ্য প্রযুক্তির এ সময়ে এ পাঠাগারের পাঠকের সংখ্যা অবাক হবার মতো। শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়ার পাশাপাশি নিজের প্রতিষ্ঠিত এ পাঠাগার থেকে দশ বছর ধরে এলাকার মহৎ ব্যক্তিদের তিনি দিয়ে আসছেন গুণিজন সম্মাননা।
কুড়িগ্রাম সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের জন্মজেলা। এই লেখক ও কবির প্রতি তৌহিদ-উল ইসলামের ভালোবাসার অন্ত নেই। তিনি শুধু সৈয়দ হক মঞ্চ স্থাপন করেই ক্ষান্ত হননি। বরং ২০১৬ সালে ২ শতাংশ জমিতে তিনি স্থাপন করেছেন ‘কবি সৈয়দ শামসুল হক কালচারাল ক্লাব’। লিখেছেন এ কবির জীবনি গ্রন্থ।
শিশুসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে ক্লাবের পক্ষে ২০২১ সালে চালু করেছেন ‘সৈয়দ শামসুল হক শিশুসাহিত্য পুরস্কার’। বার্ষিক এ পুরস্কারের অর্থমূল্য কুড়ি হাজার টাকা। এ সব আয়োজনে কারো নিকট থেকে তিনি কোনো চাঁদা গ্রহণ করেন না। শিক্ষকতা করে যা পান তার অর্ধেক ব্যয় করেন এ সব সামাজিক কর্মকাণ্ডে।
২০২১ সালে কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হকের হাত দিয়ে এ পুরস্কারের শুভ সূচনা ঘটে। ইতোমধ্যে ফারুক নওয়াজ, স.ম. শামসুল আলম, রমজান মাহমুদ, দীলরুবা নীলা, নিলয় নন্দী ও আখতারুল ইসলাম এ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘরের পরিচালক জানান, শিক্ষায় বহুমুখী অবদান ও সাফল্যের জন্য তউহিদুল ইসলাম ২০২২ সালে জাতীয় ভাবে দুই লক্ষ টাকার পুরস্কারসহ ‘আইপিডিসি-প্রথম আলো’ প্রিয় শিক্ষক সম্মাননায় ভূষিত হন। এ টাকায় শুরু করেন বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর নির্মাণের কাজ। নিজের আরও কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয়ে ২০২৩ সালে শিক্ষার্থীদের জন্য লেখক জাদুঘরটি উন্মুক্ত করেন।
এ জাদুঘরে রয়েছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ১৪০ বছর পূর্বের বঙ্গদর্শন, প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ১১০ বছর পূর্বের ‘সবুজ পত্র, এ ছাড়াও মাসিক প্রবাসী, মাসিক ভারতবর্ষ প্রভৃতি শত বছরের অসংখ্য পুরাতন সাহিত্য পত্রিকা। দৈনিক পত্রিকাও রয়েছে অসংখ্য। বিশেষ করে পাক-ভারত যুদ্ধের সময়ের দৈনিক পাকিস্তান। সত্তুরের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে দৈনিক ইত্তেফাক। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অসংখ্য দৈনিক পত্রিকা এবং দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর ১ম জন্মদিন ১৭ই মার্চের দৈনিক পূর্বদেশ ও দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকার বিশেষ সংখ্যাসহ অসংখ্য দৈনিক পত্রিকা। দুই শতাধিক প্রয়াত কবি লেখকের তথ্য সম্বলিত ছবি। শত বছর পূর্বের বেশ কিছু বই। আরও অনেক কিছু। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মূল্যবান দলিলে সমৃদ্ধ পল্লির ধুলো-মাটিতে গড়ে ওঠা এ জাদুঘরে প্রবেশ করলে আপনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের সুদূর অতীতে পৌঁছে যাবেন। রাজধানীর বাইরে ও বাংলা একাডেমির লেখক জাদুঘরের পরেই বলা যায় এটিই দেশের দ্বিতীয় লেখক জাদুঘর।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্কুল শিক্ষক তউহিদুল ইসলামের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি কেন্দ্রিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ইতোমধ্যেই শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে সমাদৃত হয়েছে।
স্থানীয় অভিভাবক মোস্তাফিজার রহমান বলেন, আমার দুই মেয়ে গীতিকার তৌহিদ-উল ইসলাম পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক। সেখানে বই আনতে গেলেই বাচ্চাদের চকলেট ও কলম দেয়া হয়। এছাড়াও প্রতিবছর সেরা পাঠককে পুরস্কৃত করে । পাঠাগারের এমন উদ্যোগ শিশুদের বই পাঠে আগ্রহী করে তুলছে। এমন উদ্যোগ আসলেই প্রশংসার দাবি রাখে।
স্কুল শিক্ষক বোস্তামী আলম বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্যারের পাঠাগার ও জাদুঘর গড়ে তোলার বিষয়টি অভাবনীয়। এ প্রতিষ্ঠান দু'টি শিক্ষার মানোন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।
পূর্ব চন্দ্রখানা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিনোদ চন্দ্র রায় বলেন, 'আমার বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী গীতিকার তৌহিদ-উল ইসলাম পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক। স্মার্টফোনের যুগেও পাঠাগারটি শিক্ষার্থীদের বই পড়ায় মনোযোগী করে তুলেছে। তাছাড়া ওনার লেখক জাদুঘরটিও বেশ সমৃদ্ধ। আমি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে জাদুঘরটি ঘুরে দেখেছি।'
পাঠাগার ও জাদুঘর নিয়ে তউহিদুল ইসলামের কাছে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ' পাঠাগারে যে বই রয়েছে তাতে এই মোটামুটি সমৃদ্ধ বলাই যায়। তারপরও বইয়ের সংখ্যা বাড়াচ্ছি। এটি অব্যাহত থাকবে। আর কালচারাল ক্লাব সংলগ্ন ১৪ শতাংশ জমি জাদুঘরের নামে আমি দান করেছি। কারো কোনো পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে চাকুরি শেষে নিজের অর্থে জাদুঘরের জন্য একটি পাঁকা ভবন নির্মাণ করবো।'
বড়ভিটা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ নূর মোহাম্মদ মিয়া বলেন, আমি যতটুকু জানি তিনি দেশের প্রতি নিজের দায়বদ্ধতা থেকে পাঠাগার ও জাদুঘর গড়ে তুলেছেন। ওনার পাঠাগারে অনেক বই রয়েছে। লেখক জাদুঘরটিও বেশ সমৃদ্ধ। বাংলা সাহিত্য ও ঐতিহ্যের অনেককিছুই জাদুঘরটিতে ঠাঁই পেয়েছে।
সায়মা