ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৩ মে ২০২৫, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে সড়ক দুর্ঘটনায় উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বন্যপ্রাণীর মৃত্যু

মোঃ মাসুদ আলম, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ

প্রকাশিত: ১০:৪৫, ২৩ মে ২০২৫; আপডেট: ১০:৪৬, ২৩ মে ২০২৫

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে সড়ক দুর্ঘটনায় উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বন্যপ্রাণীর  মৃত্যু

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে যাওয়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে দ্রুতগতির যানবাহনের চাপায় বন্যপ্রাণী মৃত্যুর ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। সম্প্রতি একটি মুখপোড়া হনুমান শাবকের মর্মান্তিক মৃত্যু এবং তার মায়ের হৃদয়বিদারক আর্তনাদ বন্যপ্রাণী প্রেমীদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। 

বন বিভাগ স্পিড ব্রেকার নির্মাণের ক্ষেত্রে সড়ক পরিবহন আইনের সীমাবদ্ধতার কথা বললেও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জরুরি ভিত্তিতে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা না নিলে এই বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ও কর্তৃপক্ষের অসহায়ত্ব
জানা গেছে, সম্প্রতি সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে একটি দ্রুতগতির মাইক্রোবাসের চাপায় একটি বিপন্ন মুখপোড়া হনুমান শাবক মারা যায়। এই দুর্ঘটনায় তার মা হনুমানটিও আহত হয় এবং দীর্ঘক্ষণ শাবকের মৃতদেহের পাশে বসে বিলাপ করতে থাকে। পরে বনকর্মীরা শাবকের দেহ জঙ্গলের ঝোঁপে ফেলে দিলে মা হনুমানটি সেখানেও কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। এ সময় গাছের ওপর থেকে অন্য হনুমানদের চিৎকারে পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। বন বিভাগ প্রতিবারই সড়ক পরিবহন আইনে স্পিড ব্রেকার নির্মাণের বিধান না থাকাকে এই ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করে।

বিগত পাঁচ বছরে শতাধিক প্রাণীর মৃত্যু
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে সাতছড়ি সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে গাড়িচাপায় শতাধিক বন্যপ্রাণী মারা গেছে। আহত হয়ে পঙ্গু হয়েছে আরও অনেক প্রাণী। জাতীয় উদ্যান ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক এক সদস্যের তথ্য অনুযায়ী, গাড়িচপায় ১২ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি কিং কোবরা, একটি শঙ্খিনী সাপ, একটি কালনাগিনী সাপ, একটি চশমাপড়া হনুমান, একটি মুখপোড়া হনুমান, একটি মায়া হরিণ ও কয়েকটি বানর মারা যাওয়ার ঘটনা তিনি নিজে দেখেছেন। এছাড়া আরও অনেক প্রাণীর মৃত্যুর খবর তার কানে এসেছে। স্থানীয়দের মতে, বানরই সবচেয়ে বেশি মারা যায়, কারণ তারা রাস্তার পাশে বেশি ঘোরাফেরা করে। এছাড়াও হনুমান, বন মোরগ, সজারু, বনরুই এবং বিভিন্ন প্রজাতির সাপ মারা যায়।

জীববৈচিত্র্য ও বর্তমান পরিস্থিতি
প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ৬০০ একর আয়তনের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে বর্তমানে ১৯৭ প্রজাতির জীবজন্তুর বসবাস। এর মধ্যে ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং আরও প্রায় ২০০ প্রজাতির পশুপাখি রয়েছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) সমন্বয়কারী সামিউল মোহসেনিন বলেন, বনের ভেতর দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার সড়কে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ২০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা থাকলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক রোড সাইন নেই। চালকরাও প্রাণীর প্রতি সদয় আচরণ করেন না। ফলে দিন দিন প্রাণী মৃত্যুর হার বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে রোড সাইন বাড়ানোসহ জরুরি প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিকল্প নেই। তিনি আরও জানান, একটি জার্মান আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা সাতছড়িতে প্রাণী মৃত্যুর হার নির্ধারণে কাজ করছে এবং এখানকার পরিস্থিতি নিয়ে তারা বেশ উদ্বিগ্ন।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মীর জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সাতছড়িতে ঠিক কত প্রাণী মারা গেছে, তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে অনেক প্রাণী যে গাড়িচাপায় মারা যাচ্ছে, তা সত্যি। মূলত সড়ক পরিবহন আইনে স্পিড ব্রেকার নির্মাণের বিধান না থাকায় এমনটা ঘটছে। তবে তিনি দাবি করেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার প্রাণী মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কমেছে। সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিদিন কয়েক শতাধিক বালু ও পাথরবোঝাই ট্রাক সাতছড়ি সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করে। এছাড়াও বাস, ট্রাক ও ট্রাক্টরসহ বিভিন্ন যানবাহন বেপরোয়া গতিতে বনের মধ্যবর্তী সড়ক ব্যবহার করছে, যা প্রাণীদের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে।

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের বন্যপ্রাণী রক্ষায় কর্তৃপক্ষের আরও জোরালো পদক্ষেপ এবং চালকদের সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যাবশ্যক।
 

নোভা

×