
কলাপাড়ায় বেড়িবাঁধের বাইরে কুয়াকাটা সৈকতের সবুজ দেয়ালখ্যাত ৯০ ভাগ বনাঞ্চল সাগরে বিলীন হয়ে গেছে
বন বিভাগ কুয়াকাটা ক্যাম্পের এক হাজার আটশ’ ১৮ একরের অন্তত আটশ’ একর সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। একইভাবে গঙ্গামতি ক্যাম্পের ১১২৮ একরের প্রায় তিনশ’ একর সাগর গিলে খেয়েছে। খাজুরা ক্যাম্পের ৩৪৬ একরের নেই অর্ধেকটা। ধুলাসার ক্যাম্পের ৪৬১ একরের একশ’ একরও নেই। ইকোপার্কসহ জাতীয় উদ্যানের নেই দুই-তৃতীয়াংশ।
এভাবে বেড়িবাঁধের বাইরে কুয়াকাটা সৈকতের দীর্ঘ ১৮ কিলোমিটার এলাকার দেড় সহ¯্রাধিক একর বনভূমিসহ সংরক্ষিত বনাঞ্চল গত ২৪ বছরে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের তা-বে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। গোটা সৈকতের অন্তত দুই কিলোমিটার প্রস্থ এলাকা সাগর গিলে খেয়েছে। দূর্যোগকালীন ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটা প্রাথমিকভাবে বাধাগ্রস্ত হওয়ার সবুজ দেওয়াল এভাবে সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ম্যানগ্রোভসহ বিভিন্ন ধরনের বনাঞ্চল বিলীনের এই ধারা অব্যাহত রয়েছে।
সৈকতের কোলঘেঁষা সবুজের দীর্ঘ আস্তরণ এখন আর নেই। এখন সব ধূসর, বিবর্ণ হয়ে আছে। খাঁ খাঁ করছে। হাজার হাজার মরা গাছের গোড়া সাক্ষী হয়ে পড়ে আছে। বনাঞ্চল যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাও ফি-বছর সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের তা-বে ভেসে যাচ্ছে। বর্ষার ছয় মাস প্রত্যেক অমাবস্যা-পূর্ণিমার তিথিতে অস্বাভাবিক জোয়ারের তা-ব উপড়ে ফেলে হাজারো গাছপালা।
মৃত শত শত গাছ কঙ্কালের মতো পড়ে থাকে। এক সময় চুরি হয়ে যায়। এভাবে সৈকতের জিরো পয়েন্টের পূর্বদিকের সৌন্দর্যম-িত স্পট ফার্মস এন্ড ফার্মস-এর দুইশ’ একরজুড়ে নারকেল, কাজু বাদাম বাগান নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শেষ চিহ্ন নেই শাল, তাল, কড়ই বাগানের।
প্রকৃতির রোষানলে সাগরের অব্যাহত ভাঙনে দৃষ্টিনন্দন সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটার দীর্ঘ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলসহ সবুজের সমারোহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। এখন অবশিষ্ট যা আছে তাও হারিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড, বন বিভাগ কিংবা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দীর্ঘদিনেও পরিলক্ষিত হয়নি।
কুয়াকাটার দীর্ঘ সৈকতের সবুজ দেওয়াল ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, সৈকতের পরিধি, সৈকতঘেঁষা বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা রক্ষায় সাগরের ভাঙন রোধে স্থায়ী কোনো পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হয়নি। শুধু প্রকল্প তৈরি করে প্রস্তাবনা আকারে পাঠানো পর্যন্ত শেষ। এরপর আর কোনো অগ্রগতি নেই। আর জিরো পয়েন্টের দুইদিকে তিনশ’ মিটার সৈকতে বেলাভূমে জিওব্যাগ ও জিও টিউবের জরুরি প্রটেকশন। যাতে শ্যাওলা ধরে গেছে।
বালু বেরিয়ে গেছে। পর্যটকরা প্রতিনিয়ত হাঁটতে গিয়ে পা পিছলে আহত হচ্ছেন। যা নিয়ে পর্যটকসহ স্থানীয়দের প্রশ্ন রয়েছে। সৈকতের বেলাভূমি ঢেউয়ের ঝাপটায় ভেসে যাওয়ায় বর্ষায় অস্বাভাবিক জোয়ারের ঝাপটায় এখন বর্ষা মৌসুমে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের স্লোপে আঘাত হানে। ঝুঁিকতে রয়েছে কুয়াকাটা পৌর এলাকা রক্ষাবাঁধ। এক কথায় চরম দুরবস্থা এবং দূর্যোগ ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের অন্যতম সৌন্দর্যম-িত সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটার মানুষ ও তাদের সম্পদ। এখানকার প্রতিবেশ-পরিবেশে জীববৈচিত্র্য চরম হুমকিতে রয়েছে।
বিনিয়োগকারীসহ পর্যটকদের দাবি জরুরিভাবে সমীক্ষা শেষে গোটা সৈকত সাগরের ভাঙন থেকে রক্ষা করা হোক। সবুজ বনাঞ্চল যেটুকু আছে তা রক্ষায় স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হোক।
স্থানীয় জেলে সফিজুল হক জানান, ২০০০ সালেও সৈকতের খাজুরা থেকে কাউয়ারচর পর্যন্ত দীর্ঘ এলাকা ছইলা-কেওড়া, গেওয়া, কড়াইসহ বিভিন্ন ধরনের গাছপালায় পরিপূর্ণ বনাঞ্চল ছিল। এখন সব সাগরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বেড়িবাঁধ থেকে সাগরের পাড়ে যেতে আধাঘণ্টা সময় লাগত। এখন পাঁচ মিনিটও লাগে না।
পরিবেশকর্মী ও কুয়াকাটা ডলফিন রক্ষা কমিটির সদস্য কে এম বাচ্চু জানান, কুয়াকাটা সৈকতের অধিকাংশ বনাঞ্চল সাগরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এখন যা আছে তা রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানালেন তিনি। কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স এসোসিয়েশন সভাপতি মোতালেব শরীফ জানান, দুর্যোগকালীন জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটা প্রাথমিকভাবে প্রতিরোধ করার সবুজ দেয়ালখ্যাত বনাঞ্চল রক্ষা করতে না পারলে গোটা কুয়াকাটার মানুষ ও তাদের সম্পদের দূর্যোগ ঝুঁকি বাড়ছে। পাশাপাশি নৈসর্গিক সৌন্দর্য হারাচ্ছেন পর্যটকরা। এসব প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করতে না পারলে এখানকার কোনো উন্নয়ন টেকসই হবে না বলেও তিনি দাবি করেন।
বন বিভাগের মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, কুয়াকাটার জাতীয় উদ্যানসহ দীর্ঘ সৈকতঘেঁষা ম্যানগ্রোভ-ননম্যানগ্রোভ ৭৫ শতাংশ বনাঞ্চল সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। যা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।