
শিল্পকলায় মঞ্চস্থ নীল ময়ূরের যৌবন নাটকের দৃশ্য
সাহিত্যের সঙ্গে শিল্পের অনন্য এক সংযোগ ঘটেছে নীল ময়ূরের যৌবন শিরোনামের নাটকে। প্রখ্যাত কথাশিল্পী সেলিনা হোসেনের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে নাটকটি। আর প্রযোজনাটি সম্প্রতি মঞ্চে এনেছে জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ। নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী পরিবেশনা রীতিবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক ইউসুফ হাসান অর্ক।
পূর্বে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটকটি মঞ্চস্থ হলেও ঢাকার দর্শকের দেখার সুযোগ হয়নি। এবার রাজধানীতে প্রযোজনাটির টানা পাঁচ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। সেই সুবাদে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির নাট্যশালার এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। আজ শুক্রবার একই ভেন্যুতে বিকেল সাড়ে চারটা ও সন্ধ্যা সাতটায় দুটি প্রদর্শনী হবে। কাল শনিবার স্টুডিও থিয়েটার বিকেল সাড়ে চারটা ও সন্ধ্যা সাতটায় আরও দুই প্রদর্শনী হবে।
নীল ময়ূরের যৌবন প্রযোজনাটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের নাট্য গবেষণারই এক প্রায়োগিক প্রয়াস। ইউসুফ হাসান অর্ক তাঁর শিক্ষক সেলিম আল দীনের মতোই খুঁজে ফিরেছেন বাঙালির নাট্যভাষার শিকড়। বাংলা অঞ্চলের হাজার বছরের পরিবেশনারীতি এবং নাট্যভঙ্গির ঐতিহ্যকে আধুনিক মঞ্চ বাস্তবতায় রূপ দেওয়ার নিরীক্ষাই প্রযোজনাটির মূল চালিকাশক্তি।
নাটকটিতে একদিকে যেমন রয়েছে বর্ণনাত্মক অভিনয়রীতি, তেমনি রয়েছে চরিত্রভিত্তিক অভিনয়ের গভীরতা। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংমিশ্রণে গড়া এই নাট্যরূপ দর্শকদের শিল্পানুভবের পরিসরকে যেমন প্রসারিত করে তেমনি শিল্পকে নিয়ে যায় আত্মার পরিশুদ্ধির পথে। প্রযোজনাটির প্রতিটি চরিত্র, বিশেষত কাজুপাদ ও ডোম্বী দর্শকদের স্মরণ করিয়ে দেয় দীর্ঘ এক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের কথা। আলোড়িত করে চেতনাকে । আর এ নাটকে নতুন জীবন পায় কুক্কুরীপাদসহ বহু চরিত্র। যেসব চরিত্র পুরাণ, ইতিহাস ও বাস্তবতার সীমানায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তোলে ও আলো জ্বালে।
প্রযোজনাটি প্রসঙ্গে নির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্ক বলেন, নাটকের ঘটনাপ্রবাহ সত্য নয়, তবে সত্যের শক্তি নিয়ে উদযাপিত। বঙ্গীয় জনপদের ইতিহাস জুড়ে বর্ণ-শ্রেণিভেদ থেকে শুরু করে আধিপত্যবাদের বহু চিহ্ন যেমন বিরাজমান, তেমনি এর বিপরীতে রয়ে গেছে প্রেম আর দ্রোহের যুগলবন্দি উত্তাল নিনাদ। এ প্রযোজনার পরতে পরতে সে সত্যের অনুধাবন করতে চেয়েছি। গীত আর কথা নির্বিবাদে এর আঙ্গিক প্রদত্ত ক্যানভাসজুড়ে সংসার পেতেছে। তাই কাহিনীর সত্যতার চেয়ে সেলিনা হোসেনের উপন্যাসই হয়ে উঠেছে মূল অবলম্বন।
এই নাট্যে উপন্যাসের সকল চরিত্রের উপস্থিতি নেই। নেই ইতিহাস অনুগমনের অভিপ্রায়ও। তবে ঘটনাবহুল এই মঞ্চ-বাস্তবতায় মানবজীবনের ধ্রুপদী বিষয়গুলোকে উপলব্ধিতে, দৃশ্যে, শব্দে, সুরতরঙ্গে গেঁথে জীবন্তদ করে তোলার প্রয়াস রয়েছে। তাই নীল ময়ূরের যৌবন নাটকে বাঙালির চিরায়ত সহজানন্দের সন্ধান লক্ষণীয়। প্রকৃতি প্রেমই যে শাশ্বত তা সহজ জীবনের উদ্ভাসেই আলোকিত।
তবুও আমাদের এই সুন্দর সহজ জীবন বাধাপ্রাপ্ত হয়, গতি হারিয়ে ফেলে অপ্রত্যাশিত কৃত্রিমতার বাধায়। প্রেমিকরা হয়ে ওঠে ে দ্রোহী। এখানে শিকারি, অরণ্যচারী, অরণ্যজীবি, গৃহী, যোগী, ভিখিরি, মাঝিমাল্লার সকলেই সমস্বরে আর্তনাদ করে ওঠে। সে আর্তনাদের স্বর, সুর ভিন্ন ভিন্ন হলেও এক বিস্ময়কর ঐক্যে নিনাদিত।
নাটকটিতে অভিনয় করছেন- মুসহিবা আফিফা চৌধুরী, জয়ন্ত ত্রিপুরা, ফেরদৌস-এ-বুশরা বাধন, উত্থিতা চৌধুরী, এলিসা সাকুরা চিসিম, হরুই মুইং স্যাং মারমা, মেনথাউ ম্রো, শুক্লা রায়, এলিজা পাংখোয়া, সাজ্জাদুল আলম, হৃদয় রায়, জান্নাত তাসফিয়া বাঁধন, ইগিমি চাকমা, প্রজয় বকসী, অর্ণব মল্লিক, আলভী করিম খান, আবু রায়হান, কৃষ্ণ চন্দ্র বর্মণ, প্রত্যাশা ত্রিপুরা, মাহমুদুল হক মায়ান, ফাহিম মালেক ইভান, শরীফ মিয়া, রবিন মিয়া, শের শাহ প্রমুখ।