
গোপালগঞ্জের বলাকইড় পদ্মবিলে প্রকৃতি ও সৌন্দর্য্যপ্রেমীদের ঘোরাঘুরি
ভাটিবঙ্গের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে রয়েছে অসংখ্য বিল। এসব বিল প্রকৃতির খেয়ালে প্রস্ফুটিত অপরূপ সৌন্দর্যের দৃশ্যপট। যা প্রখ্যাত সব শিল্পীর শিল্পকেও হার মানায়। চোখ জুড়ানো এসব দৃশ্য যেন টুকরা টুকরা সোনার বাংলা। আবহমান বাংলার রূপরস ও সৌন্দর্য প্রকৃতি তার আপন মহিমায় সাজিয়ে রেখেছে অনাগত প্রজন্মের জন্য উপভোগ্য করে। শুধু অনাগত প্রজন্মই নয়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এর রূপ-লাবণ্য উপভোগ করে মনের পিপাসা মিটিয়ে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও যাবে।
এসব বিল শুধু সৌন্দর্যম-িতই নয়, বিলগুলোয় সমাগম ঘটে হাজারো সৌন্দর্যপিপাসুর। পাশাপাশি এসব বিলের চারপাশে হাজার হাজার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা চলে বিলের জীববৈচিত্র্য, জলজ উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণী আহরণ করে। মানুষের জীবনধারণের জন্য কোনোকিছুর অভাব নেই এসব বিলে। রয়েছে নানা গুল্ম ও জলজ উদ্ভিদ ও বিভিন্ন প্রজাতির মিঠা পানির মাছ। আছে আরও নানা জলজ প্রাণী।
ভাটিবঙ্গের যেসব অঞ্চলের বিলের সৌন্দর্য বর্ণনা করা হচ্ছে সেসব অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে মাদারীপুর সদরে পিতম্বর বিল, রাজৈরে লখন্ডার বিল, কদমবাড়ি পদ্মবিল, সদর ও শিবচর উপজেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত বিল পদ্মা, শিবচরের ময়নাকাটা বিল, রাজৈর উপজেলার কোটালীপাড়া নিয়ে বিল বাঘিয়া, টুঙ্গিপাড়া লাল শাপলা বিল, রামশীল বিল, রাধাগঞ্জ বিল, কাফুলাবাড়ি বিল, গোপালগঞ্জ সদরে বলাকইড় পদ্মবিল, গোপালগঞ্জ সদর ও মুকসুদপুর অঞ্চলজুড়ে চান্দা বিল। এই চান্দা বিল এ অঞ্চলের মধ্যে সর্ববৃহৎ।
গোপালগঞ্জ জেলার পার্শ্ববর্তী বরিশাল জেলার উজিরপুর লাল শাপলার বিল (সাতলা)। এইসব বিলের মধ্যে বিল বাঘিয়াসহ দুই-একটি বিল নানা কারণে অস্তিত্ব সংকটে। একই অবস্থা গোপালগঞ্জ-মুকসুদপুর এলাকার বৃহৎ জলাধার চান্দার বিলের। তবে চান্দার বিলে জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। এই বিলেও রয়েছে নানা গুল্ম ও জলজ উদ্ভিদ ও বিভিন্ন প্রজাতির মিঠা পানির মাছ। আছে নানাপ্রকার জলজ প্রাণী। এই বিলকে ঘিরে বিলের চারপাশে বসবাসরত প্রায় ৫০ হাজার মানুষ খেয়েপরে বেঁচে আছেন। এদের অধিকাংশ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মৌলিক হিন্দু ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়। এদের জীবন- জীবিকার একমাত্র উৎস চান্দার বিলের মাছ ও নানাপ্রকার জলজ প্রাণী।
প্রায় ৮শ বছর আগে সৃষ্ট এই চান্দার বিলের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৭০ বর্গকিলোমিটার। ধীরে ধীরে মানুষের প্রয়োজনে বিলের চারপাশে জনবসতি গড়ে ওঠে, যা এখনো চলমান রয়েছে। যে কারণে এই চান্দার বিলের দৈর্ঘ্য হ্রাস পেয়ে বর্তমানে প্রায় ৫০ বর্গকিলোমিটারে নেমে এসেছে।
চান্দার বিল বছরে ৮ মাস থাকে জলমগ্ন। শুষ্ক মৌসুমের ৪ মাস বিলে এক ফসল অর্থাৎ বোরো ধানের আবাদ করা হয় ৮০ ভাগ শুষ্ক জমিতে। বর্ষা মৌসুম এলেই বিল পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। দুই-এক মাস যেতে না যেতেই নানা প্রকার জলজ উদ্ভিদ ও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শিকারের ধুম পড়ে যায়। বিলের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক বড় বড় গর্ত রয়েছে; যা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট। এসব গর্তের পানি কখনো শুকায় না। গর্তগুলো গভীর হওয়ায় অনেকে গর্তে নেমে মাছ শিকার করার সাহস পায় না। বর্ষায় পুরো বিল জলমগ্ন হলে মাছগুলো বেরিয়ে আসে।
তখন এলাকার লোকজন দেশীয় নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছ শিকারে নেমে পড়েন। বিলে শত শত ভেসাল পেতে, খেপলা জাল, চায়না দুয়ারী, জুতি, কোচ, দুয়াড়ি, চাঁই, পলোসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি দিয়ে মাছ শিকার করা হয়। প্রচুর পরিমাণে নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। স্থানীয়রা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করেন মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন আড়ত ও হাট-বাজারে।
এদিকে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়া ৫/৭টি বিলে এখন লালের সমারোহ। বিলের লাল শাপলা দেখে মনে হয় প্রকৃতি যেন বিলজুড়ে লালগালিচা বিছিয়ে রেখেছে। বিলের কালো জলে লাল শাপলার অপরূপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে সবাইকে আকৃষ্ট করছে। বিলের প্রাকৃতিক এ সৌন্দর্য উপভোগ করতে দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থী আসেন। তারা নয়নাভিরাম প্রকৃতির এ অপার সৌন্দর্য উপভোগ করেন। দিন দিন এসব বিলে লাল শাপলার উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। লাল শাপলা ভ্রমণপিপাসুদের জন্য বাড়িয়ে দিচ্ছে বাড়তি আকর্ষণ। টুঙ্গিপাড়া উপজেলার এসব বিলে মে মাসের দিকে জমিতে জোয়ার ও বর্ষার পানি এসে যায়। এ পানিতেই প্রতিবছর প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয় লাল শাপলা।
সরকারিভাবে লাল শাপলা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়ে এসব বিলে নৌ বিহারের ব্যবস্থা করা হলে এলাকার মানুষের আর্থ-সামজিক ব্যবস্থার উন্নতি হবে বলে মনে করেন দর্শনার্থীরা। এ ছাড়া লাল শাপলা দেশের অন্যান্য জেলায় সবজি হিসেবে রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এলাকার মানুষ শাপলা সংগ্রহ করে বাড়তি আয়ের সুযোগ পাবেন বলে স্থানীয়রা জানান। জানা গেছে, ১৯৮৮ সালের পর থেকে এখানে লাল শাপলা জন্মাতে শুরু করে। চারদিক লালে লালে একাকার হয়ে যায়। লাল শাপলার বিল দেখতে এখানে অনেকেই দূর- দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন। লাল শাপলার অভূতপূর্ব দৃশ্য মন ভরিয়ে দেয়।
গোপালগঞ্জ সদরে রয়েছে বলাকইড় পদ্মবিল। এই পদ্মফোটা বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে সৌন্দর্যপ্রেমীরা ছুটে আসেন বলাকইড় পদ্ম বিলে। তারা অনাবিল আনন্দ করতে মনের প্রশান্তিতে বিলে নেমে পদ্মফুল জড়িয়ে কেউ কেউ ছবি তোলেন মধুময় স্মৃতি ধরে রাখতে। এমন দৃশ্য দেখে কে শূন্যহাতে ফিরে যেতে চায়? ভাটিবঙ্গের মধ্যে শুধু একটা নয়; আরও একটি পদ্মবিল রয়েছে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ি হয়ে কোটালীপাড়া পর্যন্ত। এই দুটি পদ্ম বিলের সৌন্দর্য পর্যটকদের মন কেড়ে নেবে অনায়াসে। অনেক শৌখিন দর্শক নিজেকে হারিয়ে ফেলেন বাংলার প্রকৃতির মাঝে।
এসব বিলের দৃশ্যপট এবং অনাবিল ও নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখে সত্যিই মনে হবে এই তো আমার সোনার বাংলা। এ ছাড়া মাদারীপুর-গোপালগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে বিল বাঘিয়া। এই বিল বাঘিয়া এখন অস্তিত্ব সংকটে। বাংলা একাডেমির পরিচালক বিশিষ্ট ফোকলোরবিদ ও গবেষক ড. তপন বাগচী ‘বিল বাঘিয়ার ঐতিহ্য ফিরে আসুক’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘পেশায় জেলে না হলেও মাছ ধরে আর মাছ বেচেই জীবন চলে তাঁদের। কিন্তু বিলে এখন মাছ কমে গেছে। বিলের শামুক ধরেও কেউ কেউ দু-পয়সা আয় করত। দূরের চিংড়ি ঘেরে বেচত সেই শামুক। শামুকও এখন ফুরিয়ে যাচ্ছে। এই বিলের নাম বাঘিয়া। একসময়ে জলজ প্রাণবৈচিত্র্যে ভরা ছিল বিল। পরিবেশ ও প্রকৃতির পরিবর্তনের কারণে এখন তা বিলুপ্তির পথে।’
বিল বাঘিয়ার অবস্থান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার কলাবাড়ি ইউনিয়নে। এই বিলে প্রায় দুইশ বছর আগে থেকেই চলে আসছে নৌকাবাইচ। দুর্গাপূজার পরে পূর্ণিমায় এই নৌকা বাইচে বৃহত্তর ফরিদপুর ও বৃহত্তর বরিশালের অসংখ্য বাচারী নৌকা অংশ নেয়। নৌকাবাইচকে ঘিরে নৌকায় বসে ভাসমান মেলা। বিলের পাশের ছোট্ট খালে এখনো নৌকাবাইচ হয়। বিল শুকিয়ে যাওয়ায় সেই মেলা এখন ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।
বিলের উত্তর কোণের গ্রাম রামনগরের অধিবাসী প্রকৌশলী গোপালকৃষ্ণ বাগচী ঢাকায় থাকেন। সুযোগ পেলেই বাড়ি আসেন। বিলের এই দুর্যোগ মোকাবিলার কর্মপন্থা নিয়ে তিনি ভাবছেন। তিনি বলেন, ‘বর্ষার শুরু থেকেই কিছু লোক শামুকের সন্ধানে সারা বিল চষে বেড়ায় ফলে শামুক এখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। আবার বর্ষার শুরুতেই পোনা মাছ শিকার ও শীতে পাখি শিকার চলে নির্বিচারে। হয়তো দুই পয়সা রোজগার করছে তারা।
কিন্তু পরিবেশের ক্ষতির বিষয়টি তারা বুঝতে পারছেন না বা আমলেই নিচ্ছেন না।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু এ কাজ করে আয়-উপার্জন হচ্ছে তাই নিষেধ করে এ কাজ থেকে তাদের বিরত রাখা কঠিন। বরং এদের জন্য বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করাই উত্তম।’
রামনগর গ্রামের বাসিন্দা, সরকারি হাসপাতালের ডা. হরষিত হালদার বলেন, ‘এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকার কারণে লোকজন স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। লোকজনের মধ্যে সচেতনতার অভাবে এখানে বাল্যবিয়ে এবং যৌতুক প্রথাও চালু রয়েছে। এদের সচেতন করার কর্মসূচি জোরদার করা দরকার।’
গ্রামের প্রবীণ মানুষদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এ বিলে এক সময় শাপলা, শালুক, শোলা, ধইঞ্চা, কলমি, বাদাবন, ঘাস, আজালিঘাস, ধাপদল, কচুরিপানা, মালঞ্চ, হেলেঞ্চা, ডুটকুরা, শেওলা, বলজগাছ, বন্যাগাছ, বিষকাটালি, ঘেচু, নলখাগড়া, বলুঙ্গাসহ নানা গুল্ম ও জলজ উদ্ভিদ ছিল। মাছের মধ্যে বড় কৈ, শিং, মাগুর, চিতল, শোল, গজার, ভেইলসা, খইলসা, পুঁটি ও সরপুঁটিসহ নানা জাতের মাছ ছিল। পাখি ছিল সারা বছর ধরেই। পাখির মধ্যে ছিল চিল, শালিক, বাবুই, টুনটুনি, বক, কোড়া, কাইম, কাদাখোঁচা, মাছরাঙা, কাজলা, বুনোহাঁস, পানকৌড়ি, সূইচড়া, নলঘোঙরা, কাক্কু, ডাহুক ইত্যাদি।
কলাবাড়ী গ্রামের কবি ও সাংবাদিক রবীন্দ্রনাথ অধিকারী বলেন, ‘বিল বাঘিয়ার আয়তন প্রায় ৪ হাজার হেক্টর। বছরের জ্যৈষ্ঠ থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত অর্থাৎ ৯ মাস এ বিলে পানি থাকে। বাঘিয়াকে ঘিরে প্রায় ২০ হাজার লোকের জীবন- জীবিকা নির্বাহ হয়। রামনগর, কলাবাড়ী, কাফুলাবাড়ী, হাজড়াবাড়ী, কদমবাড়ী, লখণ্ডা, গোবিন্দপুর, বৈকুণ্ঠপুরসহ ছোট ছোট গ্রামের ভূমিহীন কৃষক আর দিনমজুরদের একমাত্র আয়ের উৎস এই বিল। কিন্তু এখন আর সেই আগের অবস্থা নেই।
বিলের পশ্চিমপাশ দিয়ে গেছে রাজৈর-কোটালীপাড়া পাকা সড়ক। বাকি তিনদিকে বিল, সরু খাল ও নিচু জমি। বিলে একসময় সাপ, গুঁইসাপ, কাঁকড়া, ব্যাঙ, আরজিনা, কাঙলাস (গিরগিটি প্রজাতির), কেঁচো, জোঁক, বিছা, জারাইল, ঘুঘরা ও অন্যান্য পোকা-মাকড়, শামুক, ঝিনুক, ফড়িং, কচ্ছপসহ নানা ক্ষুদ্র প্রাণীর বসবাস ছিল যাতে প্রকৃতিগতভাবেই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হতো। এখানে মাটির উর্বরতার কারণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার ছাড়াই ধান, শাক-সবজি, মসল্লা ও মাছ চাষ হয়ে থাকে বলে এর স্বাদও অন্যরকম।
দিনদিন বিলটি তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। মাছের প্রাচুর্য নেই, কর্মহীন হয়ে পড়েছে লোকজন, হারিয়ে ফেলেছে তাদের পৈত্রিক পেশা ও উপার্জনের পথ। বছরের ৯ মাস পানি থাকে। তাই একবার বোরো ধান ছাড়া অন্য কোনো ফসলের আবাদ করা যায় না। সেজন্য বছরের ৬ মাসই অধিকাংশ লোকের কোনো কাজ থাকে না।
বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন কাজ বিবেচনায় আনা যেতে পারে। তা হলো, বর্ষাকালে কচুরিপানা দিয়ে ২৫-৩০ হাত লম্বা ও ৮-১০ হাত চওড়া আইল বা ধাপ (স্থানীয় ভাষায় বাইড়া) তৈরি করে তাতে মসলা ও সবজি চাষ করা। ভাসমান এ ধাপে উচ্ছে, ঢেঁড়স, শসা, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, তরই, ডাঁটা, বরবটি, শিম, পুঁইশাক, চুপরিশাক, কচু, বাঙ্গি, হলুদ চাষ করা যায়। নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়েও লোকজন স্থানীয় বাজারে সবজি বিক্রি করে লাভবান হতে পারে। সবজির দাম ভালো থাকায় এর থেকে যা আয় হবে তা শামুক বিক্রি থেকে বেশিই হবে। বস্তুত এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ আগের থেকে প্রচলিত থাকলেও ব্যাপকভাবে তা হচ্ছে না। প্রকৌশলী গোপালকৃষ্ণ বাগচী জানান, ‘খাঁচায় মাছচাষ, ঘরে বসে জালবোনা, মহিলাদের জন্য সূচিশিল্প ও গবাদিপশু পালনসহ নানা প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করে দিলে এলাকাবাসী সচেতন হবে ও পরিবেশ ধ্বংসকারী কাজ করা থেকে বিরত থাকবে।’
ভাটিবঙ্গের আরও এক অপরূপ সৌন্দর্যের নাম বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার সাতলা বিল। এই বিলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ফোটে লাল শাপলা। এখানকার সৌন্দর্য উপভোগ করে দর্শনার্থীরা তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন এইভাবে, ‘বর্ষা মৌসুমে দক্ষিণের ঝিরিঝিরি হাওয়ায় ফুটতে শুরু করে লাল শাপলা। বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার সাতলা বিল এলাকা এখন শাপলার অনাবিল সৌন্দর্যের লীলাভূমি। প্রকৃতির নিয়মে সূর্যের আভাকেও যেন হার মানিয়েছে বিলের পানিতে লতাপাতাগুল্মে ভরা হাজার হাজার লাল, নীল ও সাদা শাপলা। এ যেন প্রকৃতির বুকে বিছানো লাল গালিচার অবারিত প্রান্তর। বছরের ৭ মাস শত শত একর জমির পানির মধ্যে জন্ম নেওয়া নানা রঙের কোটি কোটি শাপলার নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে আসেন দূর-দূরান্তের প্রকৃতিপ্রেমী সৌন্দর্য-পিপাসুরা। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় হাজারো মানুষের ভিড় জমে শাপলা বিলের চারপাশে। অনেকে শাপলা হাতে নিয়ে ছবি তোলেন, অনেকে ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় চড়ে বিলের নানা প্রান্তে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তোলে, কেউ কেউ নেচে গেয়ে সৌন্দর্যের মাঝে হারিয়ে যায়; আনন্দ উপভোগ করেন। দর্শনার্থীদের আনাগোনায় সারাদিন মুখরিত থাকে লাল শাপলার বিলে। শাপলার অনাবিল সৌন্দর্যে মুগ্ধ দর্শনার্থীরা তাদের অনুভূতি প্রকাশের ভাষাও হারিয়ে ফেলে। এ যেন এক অন্য রাজ্য। এখানে এলে কিছু কিছু মানুষের বিষাদের মনও আনন্দে ভরে ওঠে।
এলাকাবাসীরা জানান, প্রায় দুইশ বছর ধরে সাতলার বিলগুলোতে নানা বর্ণের শাপলা জন্মাচ্ছে। এলাকার প্রায় ৫০/৬০ ভাগ মানুষ শাপলার চাষ ও বিপণন কাজের সঙ্গে জড়িত। স্থানীয়রা অনেকেই জানান, তাদের এলাকায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা পর্যটকদের সুবিধার্থে সাতলা এলাকায় আবাসন ব্যবস্থা প্রয়োজন। প্রায় ৩ বছর আগে উজিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ সিকদার বাচ্চু শাপলা বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসা পর্যটকদের জন্য কালবিলা এলাকায় একটি ছোট্ট আবাসন নির্মাণ করেন। এই বিলের রূপ-লাবণ্য পর্যটকদের এতটাই বিমুগ্ধ করে যে, একবার যারা এখানে আসেন; তারা সময় পেলেই বারবার ছুটে আসেন। উজিরপুর সাতলার রঙিন শাপলা বিলের মোহনীয় সৌন্দর্য দূরের মানুষকে আপন করে কাছে টেনে আনে। এখানেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আয়ের উৎস শাপলা-শালুক। এলাকার মানুষগুলো আয়ের পথ হিসেবে শাপলা তোলাকে বেছে নিয়েছেন। প্রতিদিন ভোরের সোনা রোদের আলোয় ছোট ছোট নৌকা নিয়ে নেমে পড়ে শাপলা বিলে শাপলা তোলার জন্য। শাপলা তুলে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন শত পরিবার। মৌসুম ছাড়া শাপলার তেমন কোনো কদর না থাকায় পানিতে জন্মে পানিতেই নষ্ট হয়ে যেত। দিনে দিনে শাপলার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তা বাজারে বিক্রি করতে শুরু করে ওই এলাকার শ্রমজীবীরা। প্রায় সারা বছরই সাতলার বিলে শাপলা পাওয়া যায়। মানুষ খাদ্যের তালিকায় শাপলাকে সবজি হিসেবে বেছে নিয়েছে। কারণ শাপলায় আয়রনের পাশাপাশি নানা ধরনের ফুডভ্যালু রয়েছে। এমনটাই বললেন সাতলার বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করে ফিরে আসা মাদারীপুরের চিকিৎসক, স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার প্রকৃতিপ্রেমীরা।
সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর ও
নীতিশ চন্দ্র বিশ্বাস, গোপালগঞ্জ