
পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের কালীনগরের বাঁধটি যে কোনো সময় বিলীন হয়ে যেতে পারে
ভরা কটালের জোয়ারে উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদীর পানির উচ্চতা বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। সঙ্গে ভারি বৃষ্টি: তার ওপর নাজুক বেড়িবাঁধ। বছর বছর পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোটি কোটি টাকা অর্থ ব্যয়। কখনো বাঁধ মেরামতের নামে আবার কখনো ভাঙন ঠেকাতে। কিন্তু দফায় দফায় বাঁধ ভেঙে তালিয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। এমন পরিস্থিতিতে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, ডুমুরিয়া ও বটিয়াঘাটা উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ। কোথাও ভেঙেছে বাঁধ, কোথাও ভাঙার উপক্রম, আবার কোথাও বেড়িবাঁধ উপচেই নোনা পানি প্রবেশ করছে লোকালয়ে। এমন স্থান অন্তত ৫০টিরও বেশি।
সকালে ঘুম থেকে উঠে রাস্তায় গিয়েই দেখি স্লুইসগেটের পাশে বেড়িবাঁধ রাতের জোয়ারে ধসে গেছে। কীভাবে ভয়াবহ ভাঙন লাগল কিছু বুঝতে পারলাম না। এমন কথাগুলো বলেন, কয়রা উপজেলার সদর ইউনিয়নের কয়রা গ্রামের আ. জলিল। দেখেই তিনি চিৎকার দিয়ে ডাকতে থাকেন, কে কোথায় আছিস ঝুড়ি কোদাল নিয়ে ছুটে আয়। বাঁধ রক্ষা না করতে পারলে চলতি রোপা আমন মৌসুমের ধানসহ শত শত বিঘা জমির মৎস্য ঘের পানিতে তলিয়ে যাবে। ঘটনাটি মাত্র দুদিন আগের। কপোতাক্ষ নদের কয়রা গ্রামের পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধের ১৩-১৪/২ নম্বর পোল্ডারের ভাঙন রোধে পাউবোর দেওয়া পাঁচ শতাধিক জিও ব্যাগ ও বড় বড় মাটির খন্ড নিয়ে বেড়িবাঁধের ২০০ মিটার অংশ নদে ধসে পড়ে। ভাঙনে হুমকিতে পড়েছে বাঁধ সংলগ্ন ২ নম্বর কয়রা, গোবরা, ঘাটাখালী, হরিণখোলা, মদিনাবাদ গ্রামসহ কয়রা উপজেলা সদরের প্রায় আট হাজার মানুষ।
এলাকার বাসিন্দা আমির শেখ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মাত্র দুই বছর আগে এই বাঁধ নির্মাণ করা হয়। তখন বাঁধের দুপাশে মাটি দেওয়া হলেও ভেতরে বালু দেওয়া হয়। এ কারণে বাঁধ দুর্বল হয়ে ধসে গেছে। এর আগে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে বাঁধের ওই স্থান ভেঙে যায়। সে সময় পাউবো ওই বাঁধ মেরামতের উদ্যোগ নেয়। তবে সঠিক তদারকি না থাকায় কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অপরিকল্পিতভাবে বাঁধটি মেরামত করে। শুধু এই স্থানটিই নয় কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী, উত্তর বেদকাশী মহেশ্বরীপুর ও সদর ইউনিয়নের অন্তত ১০টি পয়েন্টে ভাঙন দেখা দিয়েছে। দ্রুত মেরামত না করলে যে কোনো সময় তলিয়ে যাবে জমির ধান, ঘেরের মাছসহ সবকিছু।
এ তো গেল কয়রার কথা। পার্শ্ববর্তী উপজেলা পাইকগাছার বাঁধ ভেঙে ও উপচে হরিঢালী, গদাইপুর ও রাড়ুলী-বোয়ালিয়া জেলে পল্লিসহ বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গত শনিবার দুপুরের জোয়ারে শিবসা ও কপোতাক্ষ নদসহ উপজেলার নদনদীতে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এমন পরিস্থিতি। স্থানীয়রা জানায়, কপোতাক্ষ নদের ভাঙনে রাড়ুলী ইউনিয়নের মালো পাড়ায় প্রায় আটশ’ মিটার, গাদাইপুরের বোয়ালিয়া মালোপাড়ায় তিনশ’ মিটার, হারিঢালীর মাহমুদকাটীতে চারশ’ মিটার, গড়ইখালীর খুতখালীতে দুইশ’ মিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। আর দেলুটি ও হরিঢালী ইউনিয়নের হরিদাসকাটী, দরগাঁহমহল, হাবিবনগর ও কপিলমুনির আগরঘাটা এলাকার ভাঙনের ক্ষয়ক্ষতির ইতিহাস বহুদিনের। এ ছাড়া সোনাতনকাটী আলমতলাসহ বিভিন্ন এলাকার ওয়াপদার বেড়িবাঁধে ভয়াবহ ধস দেখা দিয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ আল-আমিন বলেন, এলাকার টেন্ডার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত রয়েছে সেখানে দ্রুত কাজ শুরু করার জন্য সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর জনপ্রতিনিধি ও পাউবোকে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
জেলার আরেক উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ। জানা যায়, তিনটি দ্বীপ পোল্ডার নিয়ে যার অবস্থান। আইলা সিডরের ক্ষত এখনো দগদগে। ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটে গোটা উপজেলাবাসীর। ৩২ ও ৩৩ নম্বর পোল্ডারে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে কাজ হলেও ৩১ নম্বর পোল্ডারের চালনা পৌরসভা এবং পানখালী ও তিলডাংগা ইউনিয়ন অরক্ষিত। তিলডাংগার বটবুনিয়া বাজার সংলগ্ন রাস্তায়সহ কয়েকটি স্থানে নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভাঙনে বেড়িবাঁধের অর্ধেক অংশ নদীগর্ভে চলে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে চলে যেতে পারে পুরা অংশ। কামিনীবাসীয়া এলাকার পরিস্থিতিও প্রায় একই। এ ছাড়া পানখালির মৌখালী ও পানখালী, চালনা পৌরসভার খলিশা ও কবরখানা রোড ভেঙে যাবে যে কোনো সময়ে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার জয়দেব চক্রবর্তী জানান, এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে পাউবোর প্রকৌশলীসহ মহাপরিচালককে বিষয়টি তৎক্ষণিকভাবে জানানো হয়েছে। আশাকরি তাড়াতাড়ি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
আর ডুমুরিয়া উপজেলার ১৭/১ নম্বর পোল্ডারে গত তিনদিন ধরে জোয়ারে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। শোভনা ইউনিয়নের বাড়ইকাঠী এলাকার নিখিল গোলদারের বাড়ি থেকে শচীন রায়ের চায়ের দোকান পর্যন্ত রাস্তার ওপর দিয়ে পানি ঢুকছে বলে জানায় এলাকাবাসী।
এ ছাড়া বটিয়াঘাটা উপজেলার সদর, সুরখালী, গঙ্গারামপুর, বালিয়াডাঙ্গা, ভান্ডরকোট ইউনিয়নের কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধ রয়েছে খুবই নাজুকভাবে।
খুলনা পাউবো-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম জানান, দীর্ঘকাল আগের বাঁধ আর নদীর গতি পরিবর্তনের ফলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তবে ইতোমধ্যে আমরা অধিক ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করেছি। কিছু স্থান মেরামতের কাজ শুরু করেছি। এ ছাড়া মজবুত বাঁধ তৈরি হচ্ছে কোনো কোনো স্থানে।