
অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত সংসদীয় আসন ঢাকা-১০
অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত সংসদীয় আসন ঢাকা-১০। রাজধানীর নিউ মার্কেট, কলাবাগান, ধানম-ি ও হাজারীবাগ থানা নিয়ে আসনটি গঠিত। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আসনটিতেও নির্বাচনী উন্মাদনা শুরু হয়েছে। পোস্টার-ব্যানারে প্রার্থিতা জানান দিচ্ছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিময় ও ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাড়িটিও এই আসনের অন্তর্গত হওয়ায় আওয়ামী লীগের কাছে এই আসনটি আলাদা গুরুত্ব বহন করে। গত ১৫ বছর ধরেই এই আসন আওয়ামী লীগের দখলে রয়েছে। অন্যদিকে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে চুপিসারে হাতছাড়া আসনটি পুনরুদ্ধারে কাজ করছে বিএনপি। ইতোমধ্যে এই আসনে পাঁচবার জরিপ চালিয়েছে দলটি।
আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১০ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যরাই এগিয়ে আছেন। স্থানীয়রাও এই আসনে নৌকার মাঝি হতে অনেকেই দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। আসনটি ধরে রাখতে বর্তমান সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনও নিয়মিত গণসংযোগ করছেন। অন্যদিকে বিএনপির আস্থাভাজন হিসেবে কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন অসীম ও মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ রবিউল আলম রবিও বিএনপির মনোনয়নের অন্যতম দাবিদার। তবে আসনটিতে ভোটব্যাংক হিসেবে বড় ফ্যাক্টর হবে নোয়াখালীর মানুষ। সরেজমিন স্থানীয় ভোটার, রাজনৈতিক কর্মী ও সুশীল সমাজের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই জানা গেছে।
যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র ফজলে নূর তাপসের স্ত্রী আফরিন তাপস ও আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করীম সেলিমের ছোট ছেলে শেখ ফজলে নাঈমের মধ্য থেকে নৌকার মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় কাউন্সিলর রফিকুল ইসলাম বাবলাও নৌকার মাঝি হতে তৎপরতা শুরু করেছেন। এদিকে বর্তমান সংসদ সদস্যও নৌকা প্রতীকের অন্যতম দাবিদার। তবে দলের সিদ্ধান্তে সবাই ঐক্যবদ্ধ হবেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা জনকণ্ঠকে এমন তথ্য নিশ্চিত করেন।
২০১৪ ও ২০১৮ সালে টানা দুবার আসনটি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।
২০২০ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হওয়ায় সংসদ সদস্য পদ ছাড়েন তিনি। পরে উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এফবিসিসিআই ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। কিন্তু কার্যত এই আসনে ফজলে নূর তাপসের আধিপত্যই এখনো রয়েছে বলে সরেজমিনে দেখা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যক্তি বলেন, ফজলে নূর তাপস ধানম-ি এলাকার আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনে বড় ভূমিকা রেখেছেন। এই এলাকায় আওয়ামী লীগ তার কারণেই একাট্টা। তবে বর্তমান সংসদ সদস্য মহিউদ্দিনের ভূমিকা না থাকার পেছনেও সে বড় কারণ। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক সময়ের বিএনপির ঘাঁটি হাজারীবাগ এলাকাটি এখন আওয়ামী লীগের দখলে। এই এলাকার ট্যানারি আবর্জনা মুক্ত করার পেছনেও তাপসের বড় ভূমিকা আছে। সব মিলিয়ে এই আসনের ১০ জনের পাঁচজন এখনো তাপসকেই সংসদ সদস্য হিসেবে জানেন।
এই আসনটির মধ্যে কম অনুন্নত হাজারীবাগ থানা। দীর্ঘদিনের ট্যানারি শিল্প গড়ে ওঠা এই এলাকায় শ্রমিকরাও এখন ভোটার। হাজারীবাগ এলাকার কালুনগরে কথা হয় মো. ওসমান গনির সঙ্গে (৬০)। তিনি বলেন, এলাকার রাস্তাঘাট ভালো হয়েছে। কিন্তু আমার মতো বৃদ্ধ মানুষের ভাতা কার্ড হয়নি। বর্তমান সংসদ সদস্যকে চিনি না, তবে স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছে ভাতার জন্য ১০ বার কাগজ দিয়ে এসেছি। স্থানীয় ভোটার মো. নান্টু একজন পক্ষাঘাত রোগী। তার অভিযোগ ভোটের সময় সবাই খোঁজ নেয়। তবে ভোট শেষ হলে আর কেউ তাদের খবর নেয় না।
দোকানি মো. শাহীন জামান জনকণ্ঠকে বলেন, গত ১০ বছরে হাজারীবাগের পরিবেশ অনেক ভালো হয়েছে। পাকা সড়ক, ময়লা-আবর্জনা আগের মতো নেই। বড় বড় ভবনও হয়েছে। এলাকা এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী নির্বাচনে শুধু দলীয় প্রতীক নয়, ব্যক্তির যোগ্যতা দেখে এলাকার মানুষ ভোট দেবেন বলে তিনি মনে করেন।
বর্তমান সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, আমার রাজনৈতিক অঙ্গনে বিচরণের চেয়ে অর্থনৈতিক আঙিনায় পদচারণা বেশি। এ ছাড়াও আমি প্রথাগত রাজনীতিক নই। তবে মানুষের সুখে-দুঃখে আমি পাশে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। আগামী নির্বাচনে তৎপরতার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি দলীয় সভানেত্রী মূল্যায়ন করবেন। তবে ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প, দরিদ্রদের মধ্যে মশারি বিতরণসহ প্রকৃত মানুষ যেন সরকারি অনুদান পায় সে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
ধানম-ি ও নিউ মার্কেট এলাকায় ধনী মানুষের বসবাস বেশি। এই এলাকায় বড় সমস্যা যানজট, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও ফুটপাত দখল। যা নিয়ে স্থানীয় নাগরিকদের অভিযোগেরও অন্ত নেই। এসব সমস্যা সমাধান ও সবুজায়ন এবং উন্নত নাগরিক সুবিধা প্রদানই প্রার্থীদের নির্বাচনী অঙ্গীকার হওয়া উচিত বলে মনে করে সামাজিক সংগঠন ধানম-ি সোসাইটি। সোসাইটির পক্ষ থেকে এলাকার মানুষের নাগরিক সুবিধা বাড়ানোরও সুপারিশ করা হয়।
ধানম-ির স্থানীয় বাসিন্দা রাসেল হাসান জানান, ঢাকাÑ১০ আসনটি ঐতিহ্যগতভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। এই আসনে শেখ পরিবারের সদস্যদের মনোনয়ন দেওয়া যথাযথ হবে। তবে আসনটিতে কে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় সেটিও যাচাই-বাছাই করা উচিত।
কলাবাগান ও নিউ মার্কেট এলাকার কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই এলাকায় স্থানীয়ভাবে যারা রাজনীতি করেন, তাদেরই আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া উচিত। কারণ হিসেবে তারা জানান, এর মধ্য দিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীরা উজ্জ্বীবিত হন। তবে সব কিছুর পরও অধিকাংশ মানুষ দলীয় মনোনয়নকেই অগ্রাধিকার দেন।
অন্যদিকে বিএনপি নির্বাচনে আসবে কী আসবে না তা নিয়ে সংশয় এখনো কাটেনি। তবে এরই মধ্যে দলটি পাঁচবার এই আসনে জরিপ চালিয়েছে। জরিপে কে এগিয়ে আছে সেটিও দেখা হচ্ছে। বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম জনকণ্ঠকে বলেন, যারা রাজনীতি করেন তাদের মধ্যে দলীয় প্রতীকে সংসদ নির্বাচন করার অভিপ্রায় সবারই থাকে।
আমিও এর ব্যতিক্রম নয়। দল যদি নির্বাচনে আসে এবং আমাকে মনোনয়ন দেয় তা হলে অবশ্যই আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব। এ জন্য সামাজিকভাবে ও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। দলের সম্ভাব্য অপর প্রার্থী মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ রবিউল আলম রবি বর্তমানে কারাগারে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। তবে হাজারীবাগসহ সংসদীয় এলাকায় তার বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী রয়েছেন।
ঢাকাÑ১০ আসনে বড় ফ্যাক্টর নোয়াখালীর মানুষ। এই আসনটিতে তাদের ভোট সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি। ২০০৮ সালে সর্বশেষ গোয়েন্দা রিপোর্টে এই এলাকার মানুষের হার ছিল ৪২ ভাগ। তবে তা ৫০ ভাগেরও বেশি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই দলের থানা পর্যায়েই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে নোয়াখালীর মানুষ রয়েছে। ফলে যারাই দলীয় প্রতীক পাবেন তারা এই নোয়াখালীর মানুষ তথা ঢাকাÑ১০ আসনের এসব ভোটারকে সমীহ করবেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮ ও ২২ নম্বর ওয়ার্ড এই আসনের অন্তর্গত। মোট ভোটার সংখ্যা তিন লাখ ১৩ হাজার ৭৫৮। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৬৯ হাজার ৮৫১ ও নারী ভোটার এক লাখ ৪৩ হাজার ৯০৭। ২০০১ সালে আসনটিতে বিএনপির আবদুল মান্নান নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৮ সাল থেকেই এটি আওয়ামী লীগের দখলে রয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একেএম রহমতুল্লাহ এই আসন থেকে নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীকে শেখ ফজলে নূর তাপস এবং ২০২০ সালের উপনির্বাচনে শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। সেই হিসেবে ১৫ বছর সংসদীয় এই এলাকাটি আওয়ামী লীগের দখলেই আছে। সেই বিবেচনায় আসনটি কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চাইবে না আওয়ামী লীগ। এদিকে বিএনপিও পুনরুদ্ধারে তৎপর।