
খুলনা-মোংলা রেলপথে দৃষ্টিনন্দন একটি স্টেশন
টুকিটাকি কাজ ছাড়া সব সম্পন্ন হয়েছে। তবুও কিছু জায়গায় রঙের তুলির শেষ আঁচড়ের জন্য আর একটু সময় প্রয়োজন। তবে রেল চলতে সমস্যা হবে না। তাই, রেল কর্তৃপক্ষ আগামী মাসের শেষ সপ্তাহে খুলনা-মোংলা রেলপথ উদ্বোধনের সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। আর চালুর সঙ্গে সঙ্গেই এতদঞ্চলের অর্থনীতিতে বইতে শুরু করবে সুবাতাস। একই সঙ্গে রূপসা নদীর ওপর নবনির্মিত রেলসেতুটি স্থান নেবে দেশের একক দীর্ঘতম সেতুর ঠিকানায়। এরই মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শেষ কাজের জন্য ২/৩ মাস সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে। ফলে বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ সময়ে এটি চালুর উদ্যোগ নিলেও শেষ মুহূর্তে নাও হতে পারে। অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ, এ ধরনের মেগা প্রকল্প দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করলে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় কম হয়।
এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি এবং ট্রানজিট সুবিধার আওতায় মোংলাবন্দর থেকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এবং নেপাল ও ভুটানের পণ্য পরিবহনে সাশ্রয় ও সহজকরণে খুলনার ফুলতলা রেল স্টেশন থেকে মোংলাবন্দর জেটি পর্যন্ত রেলপথ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় খুলনা-মোংলা রেললাইন প্রকল্পটি ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পায়। শুরুতে প্রকল্প মেয়াদ ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দফায় দফায় বেড়েছে সময় আর অর্থ।
জানা যায়, প্রথম দফায় প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৭২১ কোটি টাকা। পরের সংশোধনীতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৮০১ কোটিতে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় দফা সংশোধনের পর ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা হয়। সেই সঙ্গে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার ২৬০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সে মেয়াদেও শেষ না হওয়ায় আবার সময়ের আবেদন করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এর পর ব্যয় না বাড়িয়ে সময় বাড়ানো হয় ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।
কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় আবেদনের প্রেক্ষিতে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সর্বশেষ সময় বেঁধে দেওয়া হয়। শুধু ধীরগতির কারণে তিন বছর মেয়াদের প্রকল্পটি এক হাজার ৭২১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে চার হাজার ২৬০ কোটি টাকা হয়েছে। দুই দফায় প্রকল্প সংশোধনের কারণে এই ব্যয় বেড়েছে দুই হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। আর তিন বছরের প্রকল্প শেষ হলো না ১৩ বছরেও। চতুর্থ দফা মেয়াদ শেষ হচ্ছে চলতি মাসেই।
স্থানীয়রা জানায়, প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক না থাকায় রেললাইনের কিছু স্থানের পাথর, বালি সরে গেছে। বিভিন্ন স্থানে লোহার পাত, তারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি হয়েছে। বৃষ্টিতে ছোট ছোট নালার সৃষ্টি হয়ে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর স্টেশন ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ায় পড়ে রয়েছে অরক্ষিত অবস্থায়।
প্রকল্পের পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান বলেন, সড়ক সংযোগের স্থানে লাইন বসানোর কাজ বাকি রয়েছে। তবে মূল লাইনের সবই সম্পন্ন। অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে নতুন এ রেলরুটটি দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে রেল চলাচল শুরু করার পরিকল্পনা নিয়েই কাজ চলছে। তবে ফিনিসিং কাজের জন্য ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চাওয়ার কাজ চলছে। আর রেল চলাচল শুরু হওয়ার পরও এক বছর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকবে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, এ ধরনের বৃহৎ প্রকল্পের সময় বারবার বাড়ালে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় হয়। আর মানুষের শুধু সুফল পেতেই বিলম্ব হয় না, নানা বিড়ম্বনায়ও পড়তে হয়। তবে প্রকল্পটি চালু হলে সত্যিই দেশের অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে।
খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বুলু বিশ্বাস বলেন, রেল চালু হলে মোংলাবন্দরের সঙ্গে দেশের রেললাইনের সংযোগ হবে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে কয়েকগুণ। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এতদাঞ্চলে অর্থনীতিতে যে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে সেটা আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে। প্রাণ পাবে মোংলা ইপিজেড। নতুন নতুন শিল্প উদ্যোক্তরা আসবে এ অঞ্চলে।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটির কাজ তিনটি ভাগে বিভক্ত। রূপসা নদীর ওপর রেলসেতু নির্মাণ, রেললাইন স্থাপন এবং টেলিকমিউনিকেশন ও সিগন্যালিং। প্রকল্পের আওতায় লুপ লাইনসহ রেলওয়ে ট্র্যাকের দৈর্ঘ্য ৮৬ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার। এরমধ্যে খুলনার ফুলতলা থেকে মোংলাবন্দর পর্যন্ত ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ। রূপসা নদীর ওপর যুক্ত হওয়া পাঁচ দশমিক ১৩ কিলোমিটার রেল সেতু ছাড়াও ২১টি ছোট আকৃতির সেতু ও ১১০টি কালভার্ট তৈরি হয়েছে। এছাড়া ফুলতলা ও মোংলাবন্দর স্টেশন ছাড়াও মাঝে স্টেশন থাকছে ছয়টা। এগুলো হচ্ছে- আড়ংঘাটা, মোহাম্মদনগর, কাটাখালী, চুলকাটি, ভাগা ও দিগরাজ। ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লারসেন অ্যান্ড টুব্রো রূপসা নদীর ওপর রেল সেতুর নির্মাণকাজ করছে। বাকি কাজ করছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইরকন ইন্টারন্যাশনাল।