
নাঙ্গলকোটের হাসানপুর স্টেশনে সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত সোনার বাংলা এক্সপ্রেস উদ্ধার করা হচ্ছে
মীর শাহ আলম, নাঙ্গলকোটের হাসানপুর থেকে ফিরে ॥ কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের হাসানপুর স্টেশনের অদূরে ঢাকাগামী যাত্রীবাহী আন্তঃনগর সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনটি সিগন্যাল বিভ্রাটের কারণেই অন্তত ৮০ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে এসে স্টেশনে দাঁড়ানো মালবাহী ট্রেনের পেছনে ধাক্কা দেওয়ায় ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ৪০/৫০ জন যাত্রী আহত হয়, তবে সোমবার পর্যন্ত মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। এই দুর্ঘটনার পর ঢাকা ও সিলেট থেকে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও চাঁদপুরের মধ্যে ট্রেন চলাচল আড়াই ঘণ্টা বন্ধ ছিল।
ঘটনায় চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এরা হলেন, সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনের গার্ড আবদুল কাদের, লোকোমাস্টার মো. জসিম উদ্দিন, সহকারী লোকোমাস্টার মো. মহসীন ও হাসানপুর স্টেশনের মেইনটেনার ওয়াহিদ। প্রাণহানি না ঘটলেও ইন্দোনেশিয়া ও চীন থেকে আমদানি করা যাত্রীবাহী ট্রেনের কোচগুলো ও ইঞ্জিনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সোমবার সকাল সাড়ে ৭টা থেকে চট্টগ্রাম ও আখাউড়া থেকে আসা রিলিফ ট্রেনের সাহায্য উদ্ধারকারী দল দিনভর উদ্ধার তৎপরতা চালায়। ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ ও ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে এরই মধ্যে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কুমিল্লা শহর থেকে সড়কপথে অন্তত ৫০ কিলোমিটার দূরে হাসানপুর রেলস্টেশনে সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, রেললাইনের পাশে দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে আছে সোনার বাংলার ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি এবং মালবাহী ট্রেনের একটি বগি। দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশে পড়ে আছে সেগুলো। দুর্ঘটনার ভয়াবহতা এতই বেশি ছিল যে, রেললাইনের প্রায় ২০০ ফুট অংশের লোহার স্লিপার ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে। বিধ্বস্ত সাতটি বগির মধ্য অন্তত চারটি মূল্যবান। বিধ্বস্ত বগিগুলো ১০/১৫ ফুট দূরে পাশের খাদে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
সরেজমিন পরিদর্শনকালে স্টেশনের পার্শ্ববর্তী পূর্ব বদরপুর এলাকার বাসিন্দা আবদুল মালেক, হাসানপুরের আবদুল মমিন, চিওড়ার সার্জেন্ট মাহাবুব, মোরশেদুর রহমান রাশেদসহ স্থানীয়রা জানান, দুর্ঘটনার পূর্ব মুহূর্তে ইফতার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দুর্ঘটনার পর যাত্রীদের উদ্ধারের পাশাপাশি খোয়া যাওয়া মালামাল স্থানীয় জনগণ উদ্ধার করে স্থানীয় বাজারের মসজিদে জমা রাখে। পরে মাইকিং করে ওই সব মালামাল যাত্রীদেরকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
হাসানপুর স্টেশনের কর্তব্যরত ভারপ্রাপ্ত স্টেশনমাস্টার মাহমুদুল ইসলাম ভূঁইয়া ও সহকারী স্টেশনমাস্টার মংকো মারমা জানান, ঘটনার দিন সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে বিদ্যুৎ চলে যায়। এতে কম্পিউটার মনিটর বন্ধ হয়ে যায় এবং সিগন্যাল পদ্ধতি কাজ না করায় আমরা ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ফিম্যান ফরহাদকে পাঠিয়ে সিগন্যাল পয়েন্ট সচল করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এর আগেই ৬টা ৪০ মিনিটে সোনার বাংলা লুপ লাইনে ঢুকে গিয়ে মালবাহী ট্রেনটিকে ধাক্কা দিলে দুর্ঘটনা ঘটে।
এদিকে সোমবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আখাউড়া থেকে আসা রিলিফ ট্রেন সকাল সাড়ে ৭টা থেকে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক আবিদুর রহমান উদ্ধারকাজ তদারকি করছেন। স্থানীয় বাসিন্দা রমিজ উদ্দিন, তাজুল ইসলাম বলেন, স্টেশন কর্মকর্তাদের ভুলের কারণে এ ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে। তারা আরও বলেন, দুর্ঘটনার প্রথমে তারা স্থানীয় লোকজন নিয়ে আটকে পড়া যাত্রীদের উদ্ধার করেন।
স্থানীয়রা বলেন, সোনার বাংলা ট্রেনের হাসানপুর স্টেশনে যাত্রাবিরতি ছিল না। তিন-চারটি স্টেশন আগে থেকেই প্রধান লাইনের জন্য সিগন্যাল দেওয়ার কথা। বিদ্যুৎ না থাকলেও এ সময়ের মধ্যে ম্যানুয়াল পদ্ধতি ব্যবহার করা যেত। কিন্তু সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে লুপ লাইন দিয়ে সোনার বাংলা প্রবেশ করে। ওই লাইনে এর আগে ৬টা ২০ মিনিটে মালবাহী ট্রেনটি দাঁড়ানো ছিল। স্থানীয়রা আরও জানান, ট্রেনটিতে ৫ শতাধিক যাত্রী ছিল। দুর্ঘটনার ভয়াবহতা দেখে অন্তত শতাধিক মানুষের প্রাণহানির শঙ্কা ছিল, আল্লাহর রহমতে এ পর্যন্ত কেউ মারা যায়নি।
এদিকে সোমবার কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, রেল দুর্ঘটনায় মাথায় ও কোমরে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত সাদ্দাম হোসেন (৪০) নামে এক যাত্রী সংজ্ঞাহীন অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন। তার নাম ছাড়া বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়নি। এদিকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক আবিদুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ করতে সময় লাগবে। তবে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া মূল্যবান বগিগুলো ইন্দোনেশিয়া ও চীন থেকে আনা। এ ঘটনা তদন্তে রেলওয়ে ও জেলা প্রশাসন পৃথক দুটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে আগামী তিনদিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
তবে চট্টগ্রাম বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক আবিদুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, দুর্ঘটনায় সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনের চালক (লোকোমাস্টার) মো. জসিম উদ্দিন, সহকারী লোকোমাস্টার মো. মহসীন, গার্ড আবদুল কাদের ও স্টেশনে মেইনটেনার আবদুল ওয়াহিদকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। রেলওয়ের বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (লোকো) মো. জাহিদ হাসান জানান, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপকের নির্দেশে দায়িত্বে অবহেলার কারণে চারজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। সরেজমিন পরিদর্শনকালে জানা গেছে, লাকসাম থেকে আসা রিলিফ ট্রেন রবিবার রাত থেকে এবং আখাউড়া থেকে আসা রিলিফ ট্রেন সোমবার সকাল সাড়ে ৭টা থেকে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত বগিগুলো উদ্ধারকাজ শুরু করে এবং উদ্ধারকাজ শেষ হতে সোমবার পুরো দিন লাগে।
এদিকে কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোশারফ হোসেন জানান, ঘটনার দিন রাতে ও পরদিন সোমবার আমাদের কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, যাত্রী ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছি এবং তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। আমাদের কমিটির সবাই একত্রে বসে এ সকল তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে পারব বলে আশা করি।