ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩০

নোয়াখালী-৪

আওয়ামী লীগের বিভাজন বিএনপির শক্তি

গিয়াসউদ্দিন ফরহাদ, নোয়াখালী

প্রকাশিত: ২৩:৫৪, ২৯ মার্চ ২০২৩

আওয়ামী লীগের বিভাজন বিএনপির শক্তি

সদর ও সুবর্ণচর উপজেলা নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের ২৭১ নম্বর আসন নোয়াখালী-৪

সদর ও সুবর্ণচর উপজেলা নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের ২৭১ নম্বর আসন নোয়াখালী-৪। পুরো জেলার নিয়ন্ত্রণ সদর থেকেই নিয়ন্ত্রণ হয় বলেই আসনটি সব দলের কাছেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসনটির বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের একরামুল করিম চৌধুরীর দলে একক আধিপত্য বিস্তারসহ নানা কর্মকা-ে জাতীয় রাজনীতিতেও এই আসনটি আলোচিত। 
তবে সম্প্রতি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ হারিয়ে সংসদ সদস্য একরাম করিম চৌধুরীর রাজনীতির প্রভাবে কিছুটা ভাটা পড়েছে। তৈরি হয়েছে বিপক্ষ বলয়। আওয়ামী লীগের এই মুখোমুখি অবস্থানে ভোটের মাঠে সুখের ঘুম দিতে চায় বিরোধী শিবির। আওয়ামী লীগের বিভাজনই এখানে বিএনপির বড় শক্তি। ক্ষমতাসীন দলের এই গ্রুপিং-দ্বন্দ্বকেই পুঁজি করে আসনটি পুনরুদ্ধার করতে চায় বিএনপি।
নোয়াখালী-৪ আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তেমন প্রস্তুতি চোখে পড়েনি। অন্যদিকে বিএনপি আছে আন্দোলনের মাঠে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, ‘এখনো তো নিশ্চিত নয়, আওয়ামী লীগের প্রার্থী কে হবেন! প্রার্থিতার ওপর নির্ভর করবে নির্বাচনী প্রস্তুতি ও আমেজ। তবে আওয়ামী লীগের একটা বড় অংশ পরিবর্তন চান।’ ভোটাররা বলছেন, ‘এখানে নির্বাচন জোয়ারে চলে। যখন যে দলের জোয়ার সেই পাস করে।’
জাতীয় সংসদের ২৭১ নম্বর এ আসনে মোট ভোটার পাঁচ লাখ ৪৪ হাজার ৩২৯। এর মধ্যে পুরুষ দুই লাখ ৭৯ হাজার ২২৪ ও নারী দুই লাখ ৬৫ হাজার ১০৫। আসনটি চারবার ছিল বিএনপির হাতে। ২০০৮ থেকে আছে আওয়ামী লীগের দখলে। 
জেলা আওয়ামী লীগের নয়া কমিটিকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে নতুন বলয়। এরই প্রভাবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যেও এক ধরনের বিভাজন তৈরি হয়েছে। তারা কেউ এমপি একরামুল করিম চৌধুরীর সঙ্গে আছেন, কেউ নয়া জেলা কমিটির নেতাদের সঙ্গে। দৃশ্যত এখন একরাম চৌধুরীর সঙ্গে আছেন সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম সামছুদ্দিন (জেহান)। এ ছাড়া নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিম, সহ-সভাপতি শিহাব উদ্দিন শাহীন ও সহিদুল্যাহ খান সোহেল, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ পিন্টুসহ অন্য নেতারা একসঙ্গে। অবশ্য এর ভেতরেও মনোনয়নের বিষয়ে আলাদা প্রত্যাশা আছে অনেকের।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী-৪ আসনে বর্তমান এমপি একরামুল করিম চৌধুরীর বাইরে এখানে প্রার্থী হতে পারেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিম, সহ-সভাপতি শিহাব উদ্দিন শাহীন। জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার আব্দুল মালেক উকিলের ছেলে গোলাম মহিউদ্দিন লাতুও এখানকার প্রার্থী। তিনি দলের দুঃসময়ে (১৯৯১ ও ২০০১) নৌকা নিয়ে এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এ ছাড়াও ২০০১ পরবর্তী দুঃসময়ের কারা নির্যাতিত ছাত্রনেতা, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, যুবলীগের সাবেক গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইকবাল মাহমুদ বাবলুও মনোনয়নপ্রত্যাশী। 
অন্যদিকে, এই আসনে মনোনয়ন চান বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর (অব) এম মান্নানও। আওয়ামী লীগের গ্রুপিং এবং দ্বন্দ্বের এই আসনে তুরুপের তাস হতে পারেন তিনিও। গত তিনটি সংসদ নির্বাচনে পরপর তিন দফা আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। এ কারণে ভোটের বিচারে অনেকাংশেই এগিয়ে রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। 
আগামী নির্বাচনেও এ আসনটি ধরে রাখতে চায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। অপরদিকে হারানো আসন পুনরুদ্ধারে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা ভেতরে ভেতরে মাঠে কাজ করছেন। বিএনপির নেতৃবৃন্দের দাবি, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে এই আসনটিতে বিএনপি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবে। আসনটিতে বিএনপির একক প্রার্থী হচ্ছেন চারবারের এমপি ও দলটির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান।
এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের একটি অংশ চায় আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী পরিবর্তনের। এই অংশের নেতাদের অভিযোগ, এমপি একরাম চৌধুরী জেলা সংগঠনের পাশাপাশি নোয়াখালী-৪ তথা সদর ও সুবর্ণচরেও আওয়ামী লীগের ব্যাপক ক্ষতি করেছেন। টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকায় ভোট বাড়ার কথা থাকলেও উল্টো কমেছে। এজন্য যেভাবে দলের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেভাবে এই আসন থেকেও সরিয়ে দিয়ে যে কোনো নেতাকে মনোনয়ন দিলে তারা পাস করিয়ে আনবেন।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের অপর অংশ একরাম চৌধুরীর মনোনয়ন নিশ্চিত দাবি করে বলেন, গত টানা তিন মেয়াদে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এর ফলে এলাকার ভোটাররাও চান উন্নয়নের রূপকার একরাম চৌধুরী আবারও এমপি হবেন। যাদের এলাকায় গণভিত্তি নেই, তারাই এমপির বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে ভোটারদের বিভ্রান্ত করতে চাইছে। 
এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শিহাব উদ্দিন শাহীন গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, তৃণমূলের দাবি হচ্ছে, নোয়াখালী সদর ও সুবর্ণচরের বাসিন্দাদের মধ্য থেকে মনোনয়ন দেওয়া হোক। আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা ও নোয়াখালীর মানুষের অভিভাবক ওবায়দুল কাদের এই দুই উপজেলা থেকে যাকেই মনোনয়ন দেবেন, আমরা পাস করিয়ে আনব কথা দিলাম।
মনোনয়নের ব্যাপারে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিম গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, ‘নেত্রী মনোনয়ন দিলে আমি প্রার্থী। না হলে না। আমাকে নেত্রী জেলার দায়িত্ব দিয়েছেন, আমি সাংগঠনিক কাজ করছি। সংগঠন গোছাচ্ছি। উনি যদি নির্বাচন করতে বলেন, করব।’
সাবেক ছাত্র ও যুবনেতা ইকবাল মাহমুদ বাবলু বলেন, আমি এলাকায় কাজ করছি, মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করছি। ছাত্রাবস্থা থেকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ আর আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। আপা (শেখ হাসিনা) যদি মনোনয়ন দেন তাহলে সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে কাজ করব। মনোনয়ন না পেলেও যিনি নৌকা নিয়ে আসবেন তার পক্ষে কাজ করব।
দলীয় কোন্দলসহ সামগ্রিক বিষয়ে কথা বলতে চাইলে একরামুল করিম চৌধুরী গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, ‘আমি যেহেতু দলের পদে নেই, আমি এটা নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। সেখানকার (নোয়াখালী-৪ সদর ও সুবর্ণচর) মানুষও আমাকে ভালোবাসে। আমার কাজ হলো মানুষের সেবা করা, মানুষের কাছে থাকা। আমি সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি। মনোনয়নের ব্যাপারে নেত্রী যেটা ভালো মনে করেন, সেটাই করব। নেত্রী যদি মনে করেন যে, ভোট করার প্রয়োজনই নেই। তাহলে ভোট করব না।
অন্যদিকে, আসনটিতে ক্ষমতাসীনদের নানা বিভাজনের মধ্যে মাঠে আছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, নির্বাচন বলতে যা বোঝায়- ভোটাধিকার প্রয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার আন্দোলনে তারা ব্যস্ত। এখন নির্বাচন নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান গণমাধ্যম কর্মীকে বলেন, ‘নির্বাচনী প্রস্তুতির বিষয়টি এখন আমাদের মাথায় নেই। ভোটাধিকার প্রয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য আমরা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে আন্দোলনে ব্যস্ত। এই দাবি কীভাবে আদায় করা যায়, সেটি ভাবছি। যে পদ্ধতিতে এখন নির্বাচন হয়, এটাতে আমরা যাব না। এটি নিয়ে কথা বলেও লাভ নেই।’
বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবে রহমান শামীম বলেন, আমরা এ সরকারের পতন ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে নির্বাচনে যাব না। আমাদের দাবি আদায় হলে এবং নির্বাচনে গেলে নোয়াখালী-৪ আসন থেকে নির্বাচন করবেন আমাদের নেতা দলের ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান। তিনিই বিএনপির একক প্রার্থী।