ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কুষ্টিয়া-২

১৪ দলের সম্ভাব্য প্রার্থী ইনু চান টানা বিজয়, বিএনপি পুনরুদ্ধার

এমএ রকিব, কুষ্টিয়া

প্রকাশিত: ২৩:৩৬, ২৩ মার্চ ২০২৩

১৪ দলের সম্ভাব্য প্রার্থী ইনু চান টানা বিজয়, বিএনপি পুনরুদ্ধার

ভেড়ামারা ও মিরপুরকে নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের কুষ্টিয়া-২ (ভেড়ামারা-মিরপুর) আসন

জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুই উপজেলা ভেড়ামারা ও মিরপুরকে নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের কুষ্টিয়া-২ (ভেড়ামারা-মিরপুর) আসন। ব্রিটিশ আমল হতেই থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল ভেড়ামারা। দেশের বৃহত্তম রেলসেতু ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’ ও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সড়ক সেতু ‘লালন শাহ সেতু’ রয়েছে এই উপজেলায়। এ ছাড়া দেশের বৃহত্তম ‘গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প’ এবং বৃহত্তম দু’টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও বাংলাদেশ-ভারত বিদ্যুৎ সঞ্চালন কেন্দ্র রয়েছে ভেড়ামারায়। 
কুখ্যাত নীলকর টেলর ও নুডসনের নীল কুটিকে কেন্দ্র করেই ১৮২০-১৮২৪ সালে এখানে প্রতিষ্ঠা হয় মিরপুর থানা ও তহসিল অফিস। ১৮৬৩ সালে মিরপুরসহ অত্র অঞ্চলকে কুষ্টিয়া মহকুমার অন্তর্গত করে তৎকালীন নদীয়া  জেলাভুক্ত করা হয়। ১৮৭৮ সালে মিরপুরে স্থাপিত হয় রেলপথ। ওই সময় থেকেই মিরপুর মূলত ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করে। ভোড়ামারা ও মিরপুর উপজেলা মিলে এ আসনে মোট ভোটারের সংখ্যা ৩ লাখ, ৯৯ হাজার ৫৮৫ জন।

এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ, ৯৯ হাজার, ১৪১ জন এবং নারী ভোটার ২ লাখ, ৪৪৪ জন। কুষ্টিয়া-২ (ভেড়ামারা-মিরপুর) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য হচ্ছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হানানুল হক ইনু। তিনি ২০০৮ সালের নবম, ২০১৪ সালের দশম এবং সবশেষ ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলের প্রার্থী হিসেবে নৌকা মার্কা নিয়ে টানা তিনবার এমপি নির্বাচিত হন। এর আগে বিভিন্ন সময় আসনটি বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টির কব্জায় ছিল। 
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে এই আসনে এমপি নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের আব্দুর রউফ চৌধুরী। পরে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির জিল্লুর রহমান, ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর আব্দুল ওয়াহেদ, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির আহসান হাবীব লিঙ্কন এবং ১৯৯১ সালে বিএনপির আব্দুর রউফ চৌধুরী এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে এই আসনে পর পর দুইবার এমপি নির্বাচিত হন বিএনপি দলীয় প্রার্থী অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম। 
এর পর ১৪ দল ও মহাজোট প্রার্থী হিসেবে নৌকা মার্কা নিয়ে ২০০৮ সালের নবম, ২০১৪ সালের দশম ও ২০১৮ সালের একদশ এমপি নির্বাচনে আসনটি বিএনপির কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। ২০১৪ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন। প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন জোটের দুই হেভি ওয়েট প্রার্থী জাসদ সভাপতি সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের বাড়ি এ নির্বাচনী এলাকায়। 
মাহবুব উল আলম হানিফ এ আসনে প্রার্থী থাকলেও জোটের স্বার্থে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আসনটি ছেড়ে দিতে হয় শরিক দল জাসদকে এবং নৌকা প্রতীক নিয়ে এখানে জয়লাভের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো এমপি হন হাসানুল হক ইনু। এর পর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন হাসানুল হক ইনু। যদি আওয়ামী লীগ জোটভুক্তভাবে নির্বাচন করে তা হলে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও হাসানুল হক ইনু এ আসনে জোটের হেভি ওয়েট সম্ভাব্য প্রার্থী। 
জাসদ দলীয় একাধিক সূত্র জানায়, হাসানুল হক ইনু এমপি (কোভিড-১৯ সময় ছাড়া) স্থানীয় নেতাকর্মীসহ মিরপুর ও ভেড়ামা উপজেলার তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত যোগাযোগ অব্যাহত রেখে মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। সময় পেলেই তিনি ছুটে আসেন এলাকায় এবং গণসংযোগের মাধ্যমে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১৪ বছরে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের কথা, শান্তি ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রার কথা। 
কুষ্টিয়া জেলা জাসদের সভাপতি গোলাম মহসিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও তিন মেয়াদে এমপির দায়িত্ব পালন করা হাসানুল হক ইনু সর্বাতœক এবং সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। গত ১৪ বছরে এলাকায় সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি ও মাঠ-ঘাট দখলের রাজনীতি এবং প্রশাসনের ওপর ক্ষমতার অবৈধ দাপট ও অপব্যবহার এমপি ইনু কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তা ছাড়া এলাকায় অন্তত ৭৫ ভাগ কাঁচা রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্টসহ জনগণের দাবি উন্নয়ন কাজগুলো তিনি গুরুত্ব দিয়ে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন। 
১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগার আলী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘যেহেতু জোট এখনো বহাল রয়েছে। তাই আমার জানামতে কুষ্টিয়া-২ আসনে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুই জোটের সম্ভাব্য প্রার্থী’। এর বাইরেও এ আসনে তিন সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে।

তারা হলেন- মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল হালিম, মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক অধ্যক্ষ ডাক্তার ইফতেখার মাহমুদ এবং কুষ্টিয়া নাগরিক কমিটি ও কুষ্টিয়া বিএমএর সভাপতি এবং কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডাক্তার এসএম মোস্তানজিদ লোটাস। এই তিন প্রার্থী আওয়ামী লীগ দলীয় টিকিট পেতে কেন্দ্রে জোর লবিং শুরু করেছেন বলে এলাকায় চাউর রয়েছে। 
অপরদিকে বিএনপি যদি একক বা জোটভুক্ত নির্বাচন করে তা হলে এ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী সাবেক এমপি কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম (বিএনপি), সাবেক এমপি আহসান হাবীব লিংকন (জাতীয় পার্টি-জাফর) ও বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রাগীব রউফ চৌধুরী। তবে আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী যেই হোক না কেন ভোটের মাঠে তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হবে বিএনপি বা তাদের সমমনা জোট প্রার্থী এটা নিশ্চিত।

এদিকে সিদ্ধান্তহীনতায় থাকা বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নিলে এ আসনে তারা চাইবে হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে। অপরদিকে ১৪ দলীয় জোট চাইবে বিজয়ের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে। যদিও বিএনপি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। 
আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল হালিম বলেন, দেশের মানুষকে ভালোবাসলে তার মধ্যেই এলাকার উন্নয়নসহ সব কথা চলে আসে। আমি দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে চাই। আগামী নির্বাচনে আমি দলীয় টিকিট চাইব। 
এলাকায় নতুন মুখ আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন সাবেক অধ্যক্ষ ডাক্তার ইফতেখার মাহমুদ জনকণ্ঠকে বলেন, কুষ্টিয়া-২ আসনে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা- পরিচালনার মধ্য দিয়ে আমি অনেক আগে থেকেই গণসংযোগ সম্পৃক্ত রয়েছি। কুষ্টিয়াসহ সারাদেশে অনেক উন্নয়ন কাজ হলেও গত ১৭/১৮ বছরে মিরপুরে উল্লেখ করার মতো কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। এখানকার প্রান্তিক মানুষজনের অবস্থা খুবই খারাপ।

এ কারণে এলাকায় আমি জনকল্যাণমূলক কাজ করে যাচ্ছি। বিভিন্ন সময়ে গৃহহারা মানুষজনকে ঘরবাড়ি তৈরি করে দিয়েছি, স্বাস্থ্যসেবা ক্যাম্প করে বহু মানুষের চিকিৎসাসেবা দিয়েছি। এলাকার মানুষজন আমাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেছে এবং তারা চাইছে ভবিষ্যতে যাতে আমি জনকল্যাণে বড় কোনো পোষ্টে আসতে পারি। 
আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী আরেক নতুন মুখ কুষ্টিয়া নাগরিক কমিটি ও কুষ্টিয়া বিএমএর সভাপতি, সার্জারি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান এবং কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডাক্তার এসএম মোস্তানজিদ লোটাস জনকণ্ঠকে জানান, ১৯৯৩ সাল থেকেই তিনি সামাজিক নানা কর্মকা-ের মাধ্যমে নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ অব্যাহত রখেছেন এবং ভেড়ামারা-মিরপুর নির্বাচনী এলাকায় জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি নৌকার টিকিট পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী।
অপরদিকে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা এবং নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপির শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসা না আসা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও কুষ্টিয়া-২ আসনে বিএনপির শক্ত ও হেভি ওয়েট সম্ভাব্য প্রার্থী সাবেক এমপি অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম। তিনি কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

সাবেক এমপি অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, দেশে এখন পর্যন্ত সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয়নি। এ সরকারের ওপর কারও আস্থা নেই। কারণ অতিতে আমরা যা দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দেন। বিশ্বাস করতে বলেন, কিন্তু নির্বাচনের দিন উল্টা কাজ করেন। যেমন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়।

ওই নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে কেউ গেল না, কিন্তু ভোট হয়ে গেল। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও আশ্বাস দিয়ে দিনের ভোট রাতে করা হলো। আর প্রশাসন তাতে সর্বাতœক সহযোগিতা করল। ফলে পরেরদিন মানুষ ভোট কেন্দ্রে গিয়ে কেউ ভোট দিতে পারল না। কাজেই শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে বিএনপি বিশ্বাস করে না এবং আমাদের আস্থা নেই।

এ আসনে অপর সম্ভাব্য প্রার্থী সাবেক এমপি জাতীয় পার্টি-জাফরের আহসান হাবীব লিংকন। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থী ছিলেন। এ আসনে বিএনপির আরেক সম্ভাব্য প্রার্থী বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ব্যারিষ্টার রাগীব রুউফ চৌধুরী।

তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় দক্ষিণ-পশ্চিম জোনাল কাউন্সিলরের চেয়ারম্যান ও তিনবারের এমপি প্রয়াত আব্দুর রউফ চৌধুরীর ছেলে। দলীয় হাইকমান্ডের সঙ্গে তার যোগাযোগ বেশ ভালো বলে শোনা যাচ্ছে। সর্বোপরি আওয়ামী লীগ সকল ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলে আসনটি অন্যের দখলে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, এমন মন্তব্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

×