ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

ব্রাহ্মণবাড়িয়া বার কালো দাগ সৃষ্টি করেছে ॥ হাইকোর্ট

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:০৫, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ব্রাহ্মণবাড়িয়া বার কালো দাগ সৃষ্টি করেছে ॥ হাইকোর্ট

আদালত অবমাননার রুল দেওয়ার পরও এফিডেভিট (হলফনামা) করে

আদালত অবমাননার রুল দেওয়ার পরও এফিডেভিট (হলফনামা) করে এর জবাব না দেওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া আইনজীবী সমিতির সভাপতিসহ তিন আইনজীবীর প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন উচ্চ আদালত। একই সঙ্গে সেখানে আইনজীবীদের আদালত বর্জন এবং বিচারপ্রার্থীদের হুমকি দিয়ে বের করার ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করে হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আইনজীবীরা শক্তি প্রয়োগ করে দেশের লিগ্যাল ইতিহাসে কালো দাগ সৃষ্টি করেছেন।’

শুনানি শেষে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি পরিস্থিতির উন্নতিতে এক মাস সময়ের আরজি জানালে হাইকোর্ট আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন। বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার এ আদেশ প্রদান করেছেন।

রুলের জবাব না দিলে আদালত অবমাননার এ মামলা আন কনটেস্টে (একতরফা) আদেশ হবে বলে মন্তব্য করেন  হাইকোর্ট। বিচারক ও আইনজীবীদের টানাপোড়েনের জেরে এক মাসের বেশি সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া  আদালতে অস্থিরতা চলছে। এর মধ্যে কয়েক ধাপে আদালত বর্জন কর্মসূচি পালন করেন আইনজীবীরা। সম্প্রতি আইনজীবীদের আদালত বর্জনের কারণে সেখানকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত ও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এ আসামিরা নিজেরাই মামলার শুনানি করেন। মঙ্গলবার থেকে জেলা ও দায়রা আদালতে বিচারকাজ চললেও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল- ১  এ বর্জন কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন আইনজীবীরা।
গত ২ জানুয়ারি জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মোহাম্মদ ফারুক ও আদালতের কর্মচারীদের সঙ্গে আইনজীবীদের অশালীন আচরণ, গালিগালাজ, হুমকি ও এজলাসে হট্টগোলের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় গত ৫ জানুয়ারি এক আদেশে জেলা বারের সভাপতি মো. তানভীর ভূঞাসহ তিন আইনজীবীকে তলব করে কেন তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে রুল দেন হাইকোর্ট।

১৭ জানুয়ারি শুনানি নিয়ে মঙ্গলবার আবারও তিন আইনজীবীকে হাজির হতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। তাদের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মোমতাজ উদ্দিন ফকির, সম্পাদক আব্দুন নূর দুলাল ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়।
শুনানিকালে অ্যাডভোকেট মোমতাজ উদ্দিন ফকির হাইকোর্টকে বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া বার ও আদালতের বিষয়টি শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে এগোচ্ছে। আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আদালত তখন উষ্মা প্রকাশ করে বলে, ‘সমাধান কিছুই হয়নি। আমরা সবই দেখছি। এটার কনসিকোয়েন্স (পরিণতি) কিন্তু সবাইকে ভোগ করতে হবে।’
আদালত আরও বলে, ‘এক মাস হয়ে গেছে। রুলের জবাবে এফিডেভিট দেননি। দিলে দেন, না দিলে না দেন। তবে, যদি জবাব না দেন তাহলে এই মামলা একতরফা নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। আমরা আমাদের মতো আগাব।’ হাইকোর্ট বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া বার (আইনজীবী সমিতি) দেশের আইনজীবী সমাজে কলঙ্কের সৃষ্টি করেছে।

আদালতের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে অচল করে রেখেছেন। কোর্ট বর্জন করেছেন, বিচারপ্রার্থীরা গেলে তাদের হুমকি দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে। বারের প্রেসিডেন্ট হোন যেই হোন কেউই কিন্তু আইনের ঊর্ধ্বে নন। বার কাউন্সিল কিছু না করলে আমরা এখান থেকেই সিদ্ধান্ত নেব। এই আইনজীবীরা কোর্টে প্র্যাকটিস করার যোগ্য কিনা সেটাও আমরা দেখব।’ 
বিচারিক কাজে অংশ নিয়েছেন আইনজীবীরা ॥ স্টাফ রিপোর্টার জানান, অবশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সকল আদালতের বিচারিক কাজে অংশ নিয়েছেন আইনজীবীরা। এতে দীর্ঘ সময়ের জটিলতার অবসান হয়ে মঙ্গলবার সকাল থেকে প্রাণ ফিরেছে আদালতঙ্গনে। নারী ও শিশু-১ আদালতের বিচারক মো. ফারুক ছুটিতে চলে যাওয়ায় বর্জনের আওতায় থাকা ওই আদালতের কার্যক্রমেও অংশ নিয়েছেন আইনজীবীরা। এতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২২টি আদালতের বিচারিক কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। সে সঙ্গে জেলা জজ আদালত ও চিফ জুডিসিয়ালও চিরচেনা রুপে ফিরেছে। সকাল থেকেই বিচারাঙ্গনে বিচারপ্রার্থীদের ভিড় লক্ষ করা গেছে।
জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান চৌধুরী কানন জানান, আদালতের অচলাবস্থা নিরসনে ১২ ফেব্রুয়ারি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, স্থানীয় সংসদ সদস্য র.আ.ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, আইন সচিব গোলাম সারোয়ারসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে আইনজীবীদের বৈঠক হয়। সেখানে তাদের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশেষ সাধারণ সভা করে নারী ও শিশু-১ আদালতের বিচারক মো. ফারুক ছুটিতে না যাওয়া পর্যন্ত ওই আদালত ব্যতীত সকল আদালতের ওপর থেকে বর্জন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
তবে নারী ও শিশু-১ আদালতের বিচারক ছুটিতে চলে যাওয়ায় সে আদালতের দায়িত্ব পালন করছেন নারী ও শিশু-৩ আদালতের বিচারক মো. রবিউল আলম। আর সেক্ষেত্রে আইনজীবীদের কোনো সমস্যা না থাকায় তারা নারী ও শিশু-৩ আদালতেই নারী ও শিশু-১ আদালতের বিচারিক কাজে অংশ নেওয়া শুরু করেছেন। এতে সকল আদালতের কার্যক্রমে আইনজীবীরা অংশগ্রহণ করায় সকল আদালতের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে। এছাড়াও আইনমন্ত্রী জেলা জজের বিষয়ে নমনীয় হতে বলায় সাধারণ সভায় সে বিষয়টি বিবেচনা করে আইনজীবীরা সে আদালত থেকে বর্জন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় আর কোনো জটিলতা থাকছে না।
এর আগে গত ১ ডিসেম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এ আইনজীবীরা মামলা দাখিল করতে গেলে বিচারক মোহাম্মদ ফারুক মামলা না নিয়ে আইনজীবীদের সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করেন বলে অভিযোগ করেন আইনজীবীরা। এ ঘটনায় ২৬ ডিসেম্বর সমিতির সভা করে আইনজীবীরা ১ জানুয়ারি থেকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের আদালত বর্জনের ঘোষণা দেয়।

এদিকে বিচারকের সঙ্গে অশোভন আচরণের অভিযোগে ৪ জানুয়ারি কর্মবিরতি পালন করেন আদালতের কর্মচারীরা। এ অবস্থায় জেলা জজ শারমিন নিগার, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক মো. ফারুক ও আদালতের নাজির মোমিনুল ইসলামের অপসারণ চেয়ে ৫ জানুয়ারি থেকে পুরো আদালত বর্জনের লাগাতার কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন আইনজীবীরা।

একপর্যায়ে আইনমন্ত্রীর আশ্বাসে জেলা ও দায়রা জজ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর আদালত বর্জন অব্যাহত রেখে বাকি সব আদালতের কার্যক্রমে অংশ নেওয়া আইনজীবীরা। তবে ৭ ফেব্রুয়ারি ৬ষ্ঠ দফায় বাড়ানো কর্মসূচির শেষদিনেও তাদের অপসারণ না করায় আবারও সব আদালত বর্জনের ঘোষণা দেয় আইনজীবীরা।

×