ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঝিনাইদহ-৩

বড় দুই দলে এক ডজন নেতা মনোনয়নের দৌড়ে

এম রায়হান, ঝিনাইদহ

প্রকাশিত: ২৩:৪৩, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বড় দুই দলে এক ডজন নেতা মনোনয়নের দৌড়ে

ঝিনাইদহ-৩ আসনটি মহেশপুর ও কোটচাঁদপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত

ঝিনাইদহ-৩ আসনটি মহেশপুর ও কোটচাঁদপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত। প্রায় এক বছর বাকি থাকলেও বড় দুই দলের প্রায় এক ডজন মনোনয়নপ্রত্যাশীর পদচারণায় জমে উঠেছে আসনটির নির্বাচনী রাজনীতি। দুদলেরই পুরাতন প্রার্থীদের পাশাপাশি নতুন সম্ভাব্য প্রার্থীরাও নির্বাচনী মাঠ গরম করতে মাঠে নেমেছে। উভয় দলে মনোনয়নপ্রত্যাশীর ছড়াছড়ি। মনোনয়ন পেতে কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। সে কারণে বিভেদ, দ্বন্দ্বও স্পষ্ট। আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীর মধ্যে হবে মূল লড়াই। আসনটিতে ভাগ বসাতে গোপনে মাঠে তৎপর রয়েছে জামায়াতও।

কোটচাঁদপুর-মহেশপুর দুটি উপজেলা, দুটি পৌরসভা ও ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে ঝিনাইদহ ৩ আসন। এ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৬০ হাজার ৯২০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৮১ হাজার ৭৪৬ জন ও নারী ভোটার ১ লাখ ৭৯ হাজার ১৭৪ জন। গত তিনটি নির্বাচনে আসনটি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী। তারা চতুর্থবারের মতো আসনটি ধরে রাখতে চায়। আর বিএনপি চায় হারানো আসনটি পুনরুদ্ধার করতে। তবে একাধিক প্রার্থিতার কারণে আসনটিতে বড় দুই দলেই দ্বন্দ্ব-বিভেদ রয়েছে। 
দেশ স্বাধীনের পর ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঝিনাইদহ-৩ আসনে মোজাম্মেল হক (জামায়াত), ’৯১ সালে সহিদুল ইসলাম (বিএনপি), ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে সহিদুল ইসলাম (বিএনপি), ’৯৬ সালের ২ জুনের নির্বাচনে সহিদুল ইসলাম (বিএনপি), ২০০১ সালে সহিদুল ইসলাম (বিএনপি), ২০০৮ সালে শফিকুল আজম খান চঞ্চল (আ.লীগ), ২০১৪ সালে নবী নেওয়াজ (আ.লীগ) এবং সবশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে শফিকুল আজম খান চঞ্চল (আ.লীগ) নির্বাচিত হন। 
এ আসনে দলীয় মনোনয়ন পেতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলে চলছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার লড়াই। যে কারণে পুরাতন প্রার্থীদের পাশাপাশি নতুন সম্ভাব্য প্রার্থীরাও মাঠ গরম করতে মাঠে নেমেছেন। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য এলাকায় গণসংযোগের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় কমিটি বা হাইকমান্ডের যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন তারা। 
এদিকে জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে এ আসনে। জামায়াতও চায় আসনটি বিএনপির কাছ থেকে নিতে। মনোনয়ন পেতে কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। জোট গত নির্বাচন হলে এই আসনে লড়াই হবে প্রধান দুই দলের মধ্যে। তবে আসনটিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীর ছড়াছড়ি। 
এ আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য শফিকুল আজম খান চঞ্চল। তিনি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি দলের সকল কর্মকা- জোরের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন। আবারও নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দলে তাঁরও একটা শক্ত অবস্থান রয়েছে। নির্বাচন করলে তাঁর বিজয় নিশ্চিত এমনটি দাবি করেছেন তাঁর কর্মী-সমর্থকরা। তিনি বিভিন্ন কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। আবার ভোটারদের নিয়ে সভা সমাবেশও করছেন।

এ ব্যাপারে শফিকুল আজম খান চঞ্চল এমপি বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমি মনোনয়নপ্রত্যাশী। দল আমাকে মনোনয়ন দিলে বিজয়ের ব্যাপারেও নিশ্চিত। আমি এলাকায় অনেক উন্নয়নমূলক কর্মকা- করেছি। কিছু উন্নয়ন কর্মকা- চলমান রয়েছে। তার মধ্যে কৃষি বিশ^বিদ্যালয় ও একটি স্থল বন্দর করতে চাই। যার কর্মকা- অনেকটা এগিয়ে আছে। আমি মহেশপুর ও কোটচাঁদপুর পৌরসভাকে অনেক উন্নত করেছি। দুটি পৌরসভায় প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করেছি।

এলাকার বড়বড় রাস্তাগুলো শেষ করেছি, ছোটখাটো পকেট রাস্তাগুলো করতে চায়। আমি এলাকার মানুষের পাশে থেকে সকল স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, রাস্তা-ঘাট-ব্রিজ-কালভার্টসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর উন্নয়ন করেছি, আরও করতে চাই। এই এলাকার জনগণ আমার সঙ্গে আছে। 
এ আসনের আওয়ামী লীগের শক্ত মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক সংসদ সদস্য মো. নবী নেওয়াজ। তিনি যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা। দলের মনোনয়ন পেলে তিনি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবেন বলে জানা গেছে। তিনি এলাকায় মিছিল, মিটিং, সভা-সমাবেশ করছেন। নির্বাচনী এলাকায় উঠান বৈঠকের খবর পাওয়া গেছে। তৃণমূল পর্যায়ে তাঁর সমর্থনও শক্ত। দলের পক্ষে মনোনয়ন পেলে বিজয়ের ঝান্ডা তার হাতেই থাকবে এমন দাবি তাঁর কর্মী সমর্থকদের। 
এ ব্যাপারে মো. নবী নেওয়াজ বলেন, এলাকার মানুষের চাপে আমি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছি। আমি দলের মনোনয়ন নিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব। আমি সংসদ সদস্য থাকার সময় এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছিলাম। পরবর্তীতে তার ধারাবাহিকতা নেই। এলাকায় কাজ করে যাচ্ছি। কর্মীদের সংগঠিত করছি। দলকে সংগঠিত করতে গিয়ে আমি বিভিন্ন সময়ে আমার দলীয় প্রতিপক্ষের হাতে লাঞ্ছিতও হয়েছি। তারপরও দলকে জীবন দিয়ে ভালোবাসি। আমি বিজয়ী হলে এলাকার মানুষের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাব। আমার সময়ের অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করবো।
এ আসনে মহেশপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাজ্জাদুল ইসলাম সাজ্জাদ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনিও মনোনয়ন পেলে বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। তিনিও রাতদিন গণসংযোগ করে যাচ্ছেন। প্রচ- শীতে অসহায় মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছেন। তার পক্ষেও দলীয় নেতাকর্মীদের সমর্থন রয়েছে।
সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক এমপি পারভিন তালুকদার মায়া এ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি নির্বাচনী হাওয়া শুরু হলে মাঝে মধ্যে এলাকায় আসেন। তিনি এলাকায় গার্মেন্টস করে অনেক কর্মী-সমর্থককে চাকরি দিয়েছেন। তৃণমূল পর্যায়ে তারও এক শক্ত অবস্থান রয়েছে। তবে এখনো তার তেমন কোনো আনাগোনা দেখা যাচ্ছে না বলে জানা গেছে।
এছাড়া এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে আরও রয়েছেন, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান, ব্যারিস্টার মহম্মদ আলী, কোটচাঁদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শরিফুন্নেছা মিকি, দলের সহ-তথ্য গবেষণা সম্পাদক এসএম জামান মিল্লাত। তাঁরা সকলেই মনোনয়নের জন্য তৎপর রয়েছেন। 
এদিকে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন-মহেশপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মেহেদী হাসান রনি। তার বাবা শহিদুল ইসলাম মাস্টার এ আসন থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। পিতার ইমেজ তার কর্মকা-কে বেশ এগিয়ে নিয়ে গেছে। দলের সকল কর্মকা-ে নিজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তিনি দলের মনোনয়নের ব্যাপারে আশাবাদী। বিএনপি নির্বাচনে গেলে তিনি দলের কাছে মনোনয়ন চাইবেন এবং এ আসন থেকে নির্বাচন করবেন। 

এ ব্যাপারে মেহেদী হাসান রনি বলেন, দল নির্বাচনে গেলে আমি দলের কাছে মনোনয়ন চাইব। আমি মনোনয়ন পেলে বিজয়ের ব্যাপারেও আশা রাখি। এ আসনে আমার বাবা অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। আমি নির্বাচনে বিজয়ী হলে আমি আমার বাবার অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করব। বাবার কর্মকা- অনুসরণ করব। অবহেলিত জনগণের চাহিদা অনুযায়ী তাদের চাহিদা পূরণ করব। আমি এখন প্রতিদিনই সাধারণ মানুষ আমাদের কর্মী সমর্থকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি। অর্থাৎ মহেশপুরের জনগণের দাহিদা এবং তাদের অনুরোধে আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির হারিয়ে যাওয়া এই আসনটি উদ্ধার করব ইনশাল্লাহ।
এ আসন থেকে বিএনপির অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী ইঞ্জিনিয়ার মোমিনুল ইসলাম মোমিন। তিনি মহেশপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক। দল নির্বাচনে গেলে এ আসন থেকে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হলে তিনি নির্বাচন করবেন। দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ভালো। প্রতিনিয়ত ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ করেন। দলের মনোনয়ন পেলে এ আসন থেকে বিজয়ের ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। 
ইঞ্জিনিয়ার মোমিন বলেন, আমি দলের মনোনয়ন পেলে বিএনপির হারিয়ে যাওয়া এই আসন পুনরুদ্ধারে জোর চেষ্টা করব। আমি এলাকার উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত রাখব। এখানে যেসব কর্মকা- হয়ে তার সবই বিএনপির আমলে হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগামীতে আমি মহেশপুরকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে গড়ে তুলব।  
এ আসন থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয়সহ তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক আমিরুজ্জামান খান শিমুলও মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজেকে প্রস্তুত করতে দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন। এ আসনে জাতীয় পার্টির (এরশাদ) একক  প্রার্থী আব্দুর রহমান। এ আসনে  জামায়াতের একটি বড় ভোট রয়েছে। বর্তমানে চাপের মধ্যেও তারা টিকে আছে। আগামী নির্বাচনে জামায়াতের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোন গণসংযোগ দেখা যাচ্ছে না। তবে গোপনে গোপনে জামায়াত তাদের সাংগঠনিক কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। এ আসনে তাদের এবার প্রার্থী অধ্যপক মতিয়ার রহমান।
এলাকার সচেতন ভোটারদের মতে, এ আসনটিতে আওয়ামী লীগ কোন্দল মেটাতে না পারলে বিএনপি জামায়াতের কাছে হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন করলে আসনটিতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে।

×