ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি 

আমাদের অ্যাম্বুশে মেজরসহ অর্ধশত পাকি সেনা নিহত হয়

জাহাঙ্গীর আলম শাহীন, লালমনিরহাট

প্রকাশিত: ০০:১৮, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

আমাদের অ্যাম্বুশে মেজরসহ অর্ধশত পাকি সেনা নিহত হয়

মো. আব্দুস ছালাম

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের যোদ্ধা মো. আব্দুস ছালাম। দেশমাতৃকাকে পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত করতে চাকরি ছেড়ে হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ
তাকে  মুক্তিযুদ্ধে যাবার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে মো. আব্দুস সালাম বলেন, অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি হয়েছি বেশ কয়েকবার। স্বাধীনতার মাত্র ১০ দিন আগে ৬ ডিসেম্বর তিস্তা রেলওয়ে সেতুতে দক্ষিণ পাড়ে পাকিস্তানি সেনাদের ট্রেনের কনভয়ে অ্যাম্বুশ করে আক্রমণ করি। সেদিনের সেই যুদ্ধে পাকিস্তানি মেজর এজাজসহ অর্ধশত পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পাকিস্তানি সেনারা নিজেদের রক্ষা করতে সেনা বহনকারী ট্রেনটি সেতু পার হলে তারা সেতুর একটি অংশ গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দিয়ে রংপুর রেলওয়ে স্টেশনের দিকে পালিয়ে যায়।
তিনি বলেন, তার ২/৩ মাস আগে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গেরিলা দল কাউনিয়া থানা আক্রমণ করে। লুট করে পাকিস্তানি সেনাদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র। লুটে নেওয়া অস্ত্র সহযোদ্ধাদের দিয়ে শক্তি বৃদ্ধি করে ছিলেন। কাউনিয়া থানা আক্রমণ করে টেপামধুপুর ইউনিয়নের সেই সময়ের ইউপি চেয়ারম্যান, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আব্দার রহমানকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করেছিলেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস ছালাম বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকিস্তানি সেনারা গভীর রাতে নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালি পুলিশ কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। শতশত পুলিশ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করে। আমার বড়ভাই আব্দুল ওহাব  পুলিশে চাকরি করতেন। বড়ভাই আব্দুল ওহাব তার স্ত্রী সন্তানদের নিরাপদ রাখতে গ্রামের বাড়ি টেপামধুপুর চলে আসেন। আরেক ছোটভাই মো. আব্দুল করিম সদ্য পাকিস্তান সার্ভিস কমিশনের অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছিল। তিনিও ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। তিন ভাই মিলে যোগ দেই ইউপি চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আব্দার রহমানের সঙ্গে।

সেই সময় ডাকাতের হাত থেকে রক্ষা পেতে গ্রামের প্রভাবশালী ধনাঢ্য পরিবারগুলোতে লাইসেন্স করা দু’নলা বন্দুক থাকত। কারও কারও বাড়িতে থ্রিনটথ্রি  রাইফেল, গাদাবন্দুকও থাকত। থ্রিনটথ্রি কার্তুজ ব্যবহার করা যেত এমন এক নলের বন্দুক ছিল। আব্দার রহমান চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গ্রামের প্রভাবশালীদের বেশ কয়েকটি বন্দুক সংগ্রহ করা হয়। টেপামধুপুরের প্রত্যন্ত দুর্গম গ্রামে পুলিশ সদস্য বড়ভাই আব্দুল ওহাবকে দায়িত্ব দেওয়া হয় স্থানীয় যুবকদের অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণের। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেওয়া হতো। তাদের প্রশিক্ষণ শিবিরের কথা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে স্থানীয় রাজাকাররা পৌঁছে দেয়।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা একদিন গভীর রাতে আব্দার রহমান চেয়ারম্যানের বাড়িতে আক্রমণ করে বসে। এটা এপ্রিল মাসের দিকের ঘটনা। পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের চিন্তা মাথায় রেখে চেয়ারম্যান বাড়ির নারী ও শিশুদের আগেই নিরাপদ আশ্রয়ে অন্য গ্রামে পাঠিয়ে দেন। সে কারণে নারী ও শিশুরা পাকিস্তানিদের আক্রমণ থেকে বেঁচে যায়। চেয়ারম্যানের বাড়িঘর লুটপাট করে পাকিস্তানি সেনা ও স্থানীয় রাজাকাররা। যাবার পথে বাড়িঘর ও গ্রামটিতে আগুনে জ্বালিয়ে ছাই করে দেয়। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে যান আব্দার রহমান চেয়ারম্যান।

তাকে পাকিস্তানি সেনারা কাউনিয়া থানায় নিয়ে আটক করে রেখে নির্মম নির্যাতন চালায়। তার কাছে মুক্তিযোদ্ধা, ট্রেনিং সেন্টার এবং কারা প্রশিক্ষণ নিয়েছে তাদের সম্পর্কে জানতে চায়। নির্যাতন করে মৃত ভেবে থানার একটি কক্ষের মেঝেতে ফেলে রেখেছিল। এ ঘটনায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক ক্ষুব্ধ হন। তারা সুসংগঠিত হয়। স্থানীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবকরা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেয়।  গভীর রাতে কাউনিয়া থানা আক্রমণ করে বসে। ঘটনার আকস্মিকতায় পাকিস্তানি সেনারা থানা চত্বর ছেড়ে পালিয়ে যায়।

বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে চলে আসে। তারা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দার রহমানকে  অর্ধমৃত অবস্থায় উদ্ধার করে ভারতে নিয়ে সুচিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। স্থানীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা ওই দলের সঙ্গে ভারতে চলে যায়। পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে পুনরায় দেশে ফিরে এসে যুদ্ধে অংশ নেন।
তিনি বলেন, আমরা তিন ভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই। কখনো একসঙ্গে, কখনো ভিন্ন গ্রুপে যুদ্ধ করি। তারা গেরিলা যুদ্ধ করেছে। যুদ্ধকালীন কমান্ডাররা যে নির্দেশ দিয়েছেন, সেটা পালন করেছে। ৬নং সেক্টরের অধীনে কাউনিয়া, বড়বাড়ি, তিস্তা, রংপুর, মডার্ন, দর্শনা, হারাগাছ, জয়মনি, কুড়িগ্রাম, রাজারহাট, গাইবান্ধা, মহিষখোঁচা, গঙ্গাচড়া, হাতিবান্ধা, আদিতমারী অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছি।

ইলেক্ট্রিক বিষয়ে পারদর্শী হওয়ায় ডেটোনেটর, ফিউচ, ডিভাইস, গ্রেনেড নিয়ে কাজ করি। রেকি করে এসে বিভিন্ন স্থাপনা উড়িয়ে দেওয়াই ছিল আমার কাজ। মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা হামলা করার প্রধান কৌশল ছিল হিট অ্যান্ড রান। শত্রুকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে ছত্রভঙ্গ করা, হতাহত করে হতভম্ব করে দেওয়া হতো। তাতে পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল দুর্বল হয়ে যেত।

×