ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলার ঐতিহ্যবাহী তৈজসপত্র কিনছেন তারা

দেশী-বিদেশী পর্যটকে মুখর লোকশিল্প মেলা

ফারুক হোসাইন, সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত: ০০:২০, ২৯ জানুয়ারি ২০২৩

দেশী-বিদেশী পর্যটকে মুখর লোকশিল্প মেলা

সোনারগাঁওয়ে লোক ও কারুশিল্প মেলার স্টলে মাটির সামগ্রী দেখছেন দর্শনার্থীরা

হস্তশিল্প সামগ্রী গ্রামবাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য। কালের বিবর্তনে শিল্প বিপ্লবের ফলে বাহারি রং ও ডিজাইনের হস্তশিল্পের তৈজসপত্র আজ বিলীন হওয়ার পথে। কারুকাজ করা কাঠের তৈরি হাতি, ঘোড়া, মাটির তৈরি পুতুল, বাঁশের তৈরি চায়ের কাপসহ নানা জিনিসও গ্রাম বাংলা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে এসব তৈজস বর্তমান ও নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশ লোক কারুশিল্প ফাউন্ডেশন চত্বরে মাসব্যাপী কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব চলছে।
শনিবার ছিল মেলার ১১তম দিন। মেলায় সোনালি আঁশ পাট দিয়ে তৈরি ভ্যানিটিব্যাগ, স্কুল ব্যাগ, টিফিনব্যাগ ও ম্যানিব্যাগসহ নানা জিনিসপত্রের পসরা নিয়ে বসেছেন কারুশিল্পীরা। তাদের নিপুণ হাতের তৈরি দেখতে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষার্থীসহ হাজার হাজার পর্যটক আসছেন। শুক্র ও শনিবার ছুটির দিন হওয়ায় দিনভর সোনারগাঁও জাদুঘরে হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠে দেশ-বিদেশীসহ নানা বয়সী পর্যটক। তারা দিনভর কেনাকাটা করছেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী ও হারিয়ে যেতে বসা বিভিন্ন হস্তশিল্পের তৈজসপত্রও। 
বিনোদনপ্রিয় দর্শকদের জন্য জাদুঘরের লেকে নৌকা ভ্রমণ, বিভিন্ন রাইডসে চড়া, লোকজ গান উপভোগ, বায়োস্কোপ দেখা, স্বজনদের নিয়ে সেলফি তোলা ও একসঙ্গে পরিবারের ছবি ক্যামেরাবন্দি করা, জামদানি শাড়ি ও বিভিন্ন স্টলে রাখা কারুকাজের নানা ঐতিহ্যের জিনিসপত্র কেনায় আনন্দের কমতি ছিল না।
প্রতিবছরই শীত মৌসুমে শুরু হয় ম্যাসব্যাপী এই লোক কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব। চীন, জাপান ও থাইল্যান্ডের পর্যটকরাও এই লোকজ উৎসব উপভোগ করতে ছুটে এসেছেন। বিদেশী পর্যটকরা বিভিন্ন স্টলগুলোতে ঘুরে ঘুরে হাতে তৈরি জিনিসপত্রগুলোর কারুকাজ দেখেন। শুক্র ও শনিবার ছুটির দিন হওয়ায় মেলায় দর্শনার্থীদের সমাগম থাকে অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু বেশি। রাজধানী ঢাকার খিলগাঁও থেকে লোক কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবে আসা পর্যটক তানজিলা আক্তার বলেন, জাদুঘরে এলে গ্রামীণ ঐতিহ্যের কথা মনে পড়ে যায়। গ্রামে সহজ-সরল মানুষের চেহারা ভেসে ওঠে।
নরসিংদীর বেলাব থেকে আসা শিক্ষার্থী তনয়, মতিন, রাতুল জানায়, এক সময় গ্রাম বাংলায় তৈজসপত্র হিসেবে ব্যবহার হতো হাড়ি পাতিল, ঢুলা, ওছা, মাইট, মাছ ধরার চাঁই, পলো, ধান ভানার ঢেঁকি, এখন আর দেখা যায় না। বর্তমান প্রজন্ম এগুলো কি কাজে ব্যবহার হতো তা চিনতে তাদের কষ্ট হয়। হারিয়ে যাওয়া সকল ব্যবহার্র্য জিনিস এখানে আসলে দেখা মেলে।

কুমিল্লা থেকে আসা এক স্কুলশিক্ষক বলেন, লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। আমাদের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রেখেছে। মেলায় ঘুরে অনেক আনন্দ পেলাম। ঢাকার গুলশান থেকে মেলায় ঘুরতে আসা মনির হোসেন বলেন, রাজধানীর কোলাহল থেকে গ্রামীণ ঐতিহ্য দেখতে মেলায় এসেছি। মেলায় ঘুরে খুবই ভাল লেগেছে।
এ বছর মেলার বিশেষ আকর্ষণ হলো আয়োজক প্রতিষ্ঠানের বিশেষ প্রদর্শনী দেশের প্রথিতযশা কারুশিল্পীদের শিল্পকর্ম নিয়ে ‘কর্মময় কারুশিল্পী’ প্রদর্শনী। মেলার মূল চত্বরের মাঠের মাঝে এর অবস্থান। ১০০টি স্টলের মধ্যে এ বছর বিশেষ প্রদর্শনীতে ২৪টি স্টলে রয়েছে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ৪৮ জন কারুশিল্পী দেশের হারানো ঐতিহ্যকে আবার নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। প্রদর্শনীর গ্যালারিগুলো কারুশিল্পীরা তাদের স্বহস্তে তৈরি করেছেন।
মেলায় রয়েছে সোনারগাঁওয়ের কারুশিল্পের কারুকাজ, নকশিকাঁথা, হাতি ঘোড়া, মমি পুতুলের বর্ণালী-বাহারি পণ্য, রাজশাহীর মৃৎশিল্প-মাটির চায়ের কাপ, শখের হাঁড়ি, নকশিকাঁথা, মুন্সীগঞ্জের শীতলপাটি, ঢাকার কাগজের শিল্প, বাটিক শিল্প, খাদিশিল্প, মণিপুরী তাঁতশিল্প, রংপুরের শতরঞ্জি শিল্প, ঠাকুরগাঁয়ের বাঁশের কারুশিল্প, মাগুরার শোলাশিল্প, টাঙ্গাইলের বাঁশ-বেতের কারুপণ্য, সিলেটের বেতশিল্প, জামালপুরের তামা-কাঁসা-পিতলের শৌখিন সামগ্রী, সোনারগাঁওয়ের বাহারি জামদানি শিল্প, বগুড়ার লোকজ বাদ্যযন্ত্র, কিশোরগঞ্জের টেরা কোটা পুতুল, কক্সবাজারের শাঁখা ঝিনুক শিল্প, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সুজনিকাঁথা, খাগড়াছড়ি ও মৌলভীবাজারের ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর কারুপণ্য, মৌলভীবাজারের বেতের কারুশিল্প, চট্টগ্রামের তালপাতার হাতপাখা, পাটজাত কারুপণ্য, লোকজ অলঙ্কার শিল্পসহ ইত্যাদি কারুপণ্য।

শিল্পীরা এখানে বসেই তাদের নিপুণ হাতে নিজস্ব মেধা ও মননে তৈরি করছেন বাহারি কারুপণ্য। তাদের নিপুণ হাতের তৈরি কারুপণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি মেলায় বিক্রি করছেন। প্রদর্শনীর গ্যালারিগুলোতে থরে থরে সাজানো কারুপণ্যের পসরা দেখে অনেকেই কেনাকাটা করছেন শখের চিত্রিত হাঁড়ি, শোলা শিল্প, কাঠের সামগ্রী, শতরঞ্জি, নকশিকাঁথা, বাঁশের তৈরিসহ বিভিন্ন কারুপণ্যসামগ্রী।
মাগুরা থেকে শংকর মালাকার ও নিখিল মালাকার বাপ ছেলে শোলাশিল্প নিয়ে এসেছেন মেলায়। তারা ২২ থেকে ২৩ বছর ধরে লোকজ মেলায় আসছেন। শোলা দিয়ে তৈরিকৃত ফুল, মাথার চুপি, বিয়ের ও পূজার ফুল। সার্বিক বিষয়ে ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক রবিউল ইসলাম বলেন, জাদুঘরের মেলা উপলক্ষে দর্শনার্থীদের জন্য কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পুরো জাদুঘরটি সিসি ক্যামেরায় নিয়ন্ত্রিত। এছাড়া ট্যুারিস্ট পুলিশসহ বিপুলসংখ্যক আইন-শৃঙ্খলাবাহিনাীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে।

×