ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৩ জুন ২০২৩, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০

যুদ্ধদিনের স্মৃতি 

নকল রাস্তার ফাঁদে ফেলে ৭০ পাকি সেনাকে হত্যা করা হয়

এম. রায়হান, ঝিনাইদহ

প্রকাশিত: ২৩:৫৪, ১৯ জানুয়ারি ২০২৩

নকল রাস্তার ফাঁদে ফেলে ৭০ পাকি সেনাকে হত্যা করা হয়

মকবুল হোসেন

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ঝিনাইদহের রয়েছে বীরত্বগাথা ইতিহাস। সে সময় যেসব মুক্তিযোদ্ধা ঝিনাইদহে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন। তার নেতৃত্বে ছিল ৭০ গেরিলা যোদ্ধা। তিনি ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার। বর্তমানে তিনি ঝিনাইদহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ইউনিট কমান্ডার। তাদের কমান্ডার ছিলেন বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই এমপি। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই তারা স্বাধীন করেছিলেন ঝিনাইদহ।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন বলেন, দেশ রক্ষায় পাকি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা বারুদের মতো জ¦লে উঠেছিলেন। বিষয়খালী প্রতিরোধ যুদ্ধ, গাড়াগঞ্জ যুদ্ধ, কামান্না ট্র্যাজেডি, আবাপুর যুদ্ধসহ ঝিনাইদহের নানা ঘটনার স্মৃতি চারণ করেন তিনি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই। যুদ্ধের সময় আমরা ঝিনাইদহ সরকারি কেসি কলেজের কেমিস্ট তফিজ উদ্দিনের সহযোগিতায় বোমা বানাতাম। ওই সব বোমা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতো। তখন আমাদের কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না, প্রশিক্ষণও ছিল না। কমান্ডার আব্দুল হাইয়ের নেতৃত্বে জীবন বাজি রেখে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি মুক্তিযুদ্ধে। 
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্মৃতি চারণে বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন বলেন, ২৬ মার্চ রাতে যশোর থেকে ২৫ গাড়ি হানাদার পাকিস্তানি আর্মি ঝিনাইদহের ওপর দিয়ে কুষ্টিয়ার দিকে চলে যায়। তারা কুষ্টিয়া জেলা স্কুল, মোহিনী মিল ও পুলিশ লাইনে অবস্থান নেয়। তাদের প্রতিরোধের জন্য ওই রাতে ঝিনাইদহ ট্রেজারি লুট করে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয় ছাত্র যুবকদের হাতে। নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন এবং এসডিও নেফাউর রহমান।

ট্রেজারি লুট করতে সহযোগিতা করেন কাঞ্চন দারোগা। তখন বুঝতে পারি, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কমান্ডার আব্দুল হাইয়ের নেতৃত্বে ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া সড়কের সবকটি ব্রিজ ভেঙে ফেলি। সে সময় আমরা ব্রিজের দু’পাশে নকল রাস্তা তৈরি করি। রাস্তার ওপর চাটাই দিয়ে তাতে আলকাতরা মেখে রাখি, যাতে দেখে প্রকৃত রাস্তাই মনে হয়। আর তার পাশে বাঙ্কার খুঁড়ে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ও জনতা অবস্থান করি, যাতে ওই ২৫ গাড়ি পাকি আর্মি যশোরের দিকে আর ফিরে যেতে না পারে।

এ ছাড়া কুষ্টিয়া শহরের চারপাশ কুষ্টিয়ার মুক্তিযোদ্ধা জনতা এবং গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা ঘিরে ফেলে। পাকিস্তানি হানাদার আর্মির বিদ্যুৎ, পানি ও খাবার বন্ধ করে দেই। উপায়ান্তর না পেয়ে কয়েকদিন পর ৩০ মার্চ রাতে হানাদার পাকিস্তানি আর্মি আবারও যশোরের দিকে ফিরতে শুরু করে। ওই রাতে শৈলকুপার গাড়াগঞ্জ ব্রিজের পাশে এসে নকল রাস্তায় এক গাড়ি পড়ে যায়। বাকি গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে যায়। সেখানে গেরিলা আক্রমণে সাতজন হানাদার পাকিস্তানি আর্মি নিহত হয়।

বাকিদের ঘিরে ফেলে হাজারো জনতা। তারা ‘জয় বাংলা’ সেøাগান দিতে থাকে। চারদিক থেকে লাঠিসোঁটা, ঢাল ভেলা নিয়ে হানাদার পাকিস্তানি আর্মির ওপর আক্রমণ শুরু হয়। রাতের অন্ধকারে তারা কুমার নদের পাড় দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। তারা কুমার নদের ওপর হুদা মাইলমারী সাঁকো পার হওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন ইটপাটকেল মারা শুরু করে। তখন হানাদার আর্মি ওই হুদা মাইলমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে চারজন এবং যাদবপুর গ্রামের দুই সহোদরকে গুলি করে হত্যা করে।

ওই সময় মাথার ওপর পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান উড়ছিল। এসব দেখেও পিছু হটেনি গেরিলা মুক্তিকামী জনতা। এরপর প্রতিরোধ আরও তীব্র হয়। রাতভর এবং সকাল পর্যন্ত গেরিলা মুক্তিকামী ও জনতার হাতে ২৫ গাড়ির ৭০ জন পাক হানাদার আর্মি মারা যায়। পাক হানাদার আর্মি কমান্ডার লে.কর্নেল আতাউল্লাহ খান আহত অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা জনতার হাতে ধরা পড়ে। পরে তাকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়।
এদিকে, যশোর থেকে আবারো পাকিস্তানি হানাদার আর্মি আসবে ভেবে বিষয়খালী ব্রিজে অসংখ্য মুক্তিকামী জনতা প্রতিরোধে অংশ নেয়। তারা রাতদিন সেখানেই অবস্থান করে। তাদের সমস্ত খাবার সরবরাহ করার জন্য লঙ্গরখানা তৈরি করা হয় ঝিনাইদহ শহরের নূরুন্নবী সিদ্দিকীর বাড়িতে। সেখান থেকে তাদের খাবার সরবরাহ করা হতো।
৩০ মার্চের ক্ষত সহ্য করতে না পেরে প্রতিশোধ নিতে যশোর থেকে ১ এপ্রিল দুপুরে আবারও হানাদার পাকিস্তানি আর্মি ঝিনাইদহের দিকে আসতে থাকে। সেদিন মহকুমা প্রধান (এসডিপিও) মাহবুবের নেতৃত্বে ঝিনাইদহের বিষয়খালী ব্রিজে তাদের প্রতিরোধ করে মুক্তিযোদ্ধা-জনতা। মুক্তিযোদ্ধা-জনতার প্রতিরোধের মুখে হানাদার বাহিনী ঝিনাইদহ শহরে ঢুকতে পারেনি। ফিরে যায় যশোর ক্যান্টনমেন্টে। এটাই ছিল ঝিনাইদহের প্রথম সম্মুখযুদ্ধ।

বিদেশী সংবাদমাধ্যম বিবিসিসহ বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয় এই যুদ্ধের খবর।
এর  পর ১৫ এপ্রিল তারা আবারও ঝিনাইদহ আক্রমণ করতে আসে। সেদিন বিষয়খালী ব্রিজের ওপর ব্যাপক প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়। এই প্রতিরোধ গড়ে তোলে মুক্তিযোদ্ধা-জনতা। বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে তারা। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মর্টার সেলসহ ভারি অস্ত্রের আঘাতে মুক্তিযোদ্ধা জনতাকে হটিয়ে ১৬ এপ্রিল ঝিনাইদহ দখল করে নেয়।

ওই প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হন ২৮ জন মুক্তিকামি বীর যোদ্ধা। এর পর পাক হানাদার বাহিনী ঘাঁটি গাড়ে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় রাজাকার আলবদররা। তারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, অত্যাচার নির্যাতন লুটপাট শুরু করে। তাদের অত্যাচারে শহরের প্রতিটি বাড়ি জনশূন্য হয়ে পড়ে। কিছু কিছু বাড়িতে বয়োবৃদ্ধরা ছিলেন। আর সব বাড়ি ফাঁকা। এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা, গেরিলা যোদ্ধা সবাই চলে যায় ভারতে। আব্দুল হাইসহ আমি ভারতের উত্তরাখ-ের দেরাদুন চাকরাতা সাবডিভিশনের টান্ডুয়া ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেই।

রণাঙ্গণের যোদ্ধা মকবুল হোসেন বলেন, প্রশিক্ষণ শেষ করে ভারতের ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে আমাদের অস্ত্র সরবরাহ করা হয়। আমার কমান্ডার ছিলেন আব্দুল হাই। আমি ছিলাম ডেপুটি কমান্ডার। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জুলাই মাসে দেশে ফিরে আসি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেই। বেশিরভাব যুদ্ধ সংঘটিত হয় শৈলকুপায়। এসব যুদ্ধের মধ্যে অন্যতম শৈলকুপা থানা আক্রমণ, আবাইপুর যুদ্ধ, আলফাপুরের যুদ্ধ ও কামান্না ট্র্যাজেডি।

২৬ নবেম্বর কামান্না গ্রামে ২৭ জন ঘুমন্ত মুক্তিযোদ্ধাসহ ২৯ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশের বাড়ি মাগুরা জেলায়। ১৪ অক্টোবর আবাইপুর যুদ্ধে আমাদের ৪১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শৈলকুপার আলফাপুর যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন মণ্টু। ওই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর দুজন ক্যাপ্টেন, তিনজন সিপাহী এবং চারজন রাজাকার মারা যায়। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোন ক্ষতি হয়নি। ১ জুলাই ভোরে শৈলকুপার বসন্তপুর, জয়ন্তীনগর ও ছোট বোয়ালিয়া গ্রাম ঘিরে ফেলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের তল্লাশি শুরু করে। কিন্তু কোনো মুক্তিযোদ্ধা না পেয়ে গ্রামে গণধর্ষণ ও ব্রাশফায়ারে ১৯ জন গ্রামবাসিকে হত্যা করে। 
তিনি বলেন, নবেম্বরের শেষের দিকে গেরিলা যুদ্ধ চরম আকার ধারণ করে। ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে (মিত্রবাহিনী) ভেতরে ঢুকে পড়ে। আমরা একসঙ্গে আক্রমণ শুরু করি। ৩ ডিসেম্বর মহেশপুর, ৪ ডিসেম্বর কোটচাঁদপুর এবং ৬ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ আক্রমণ করা হয়। পালিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার আর্মিরা। ৬ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ জেলা হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্তি লাভ করে।
১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ৮নং সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর সিআর দত্ত আমাদের অস্ত্র সমর্পণের অনুরোধ করেন। কিন্তু আমরা অস্ত্র সমর্পণ না করে জানিয়ে দেই, বঙ্গবন্ধু দেশে না আসা পর্যন্ত আমরা অস্ত্র সমর্পণ করব না। পরে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলে আমাদের অস্ত্র সমর্পণের কথা জানালে তার ডাকে সাড়া দিয়ে আব্দুল হাইয়ের নেতৃত্বে আমরা ১০টি বাস-ট্রাক ভরে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঢাকাই যায় এবং স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধুর সামনে আমরা সমস্ত অস্ত্র সমর্পণ করি।