ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

যেখানে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঁশ

প্রকাশিত: ২০:১৫, ২৪ জুলাই ২০২১

যেখানে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঁশ

সমুদ্র হক ॥ প্রতিদিন বগুড়ার নগীর কেন্দ্রস্থল সাতমাথার অতি নিকটে পূর্বদিকে প্রধান ডাকঘরের সামনে হাজারও মানুষের যাতায়াত। সেখানে কৃষ্ণচূড়া চত্বরে ভ্রাম্যমাণ চা দোকানি দিনভর বসে। পোস্ট অফিসে প্রতিদিন চিঠিপত্র ছাড়াও কত কাজে মানুষ যায়। সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় বাংলার চিরচেনা ঘাস। বগুড়া নগরীর মানুষকে যদি বলা হয়- আপনি কি শহরে বাঁশবাগান, বাঁশের আড়া (স্থানীয় কথায় আড়া হলো বাগান) দেখেছেন! উত্তর না সূচক। যদি বলা হয় নগরীর সাতমাথায় আছে। -পাগল! না মাথায় ছিট আছে। হ্যাঁ। বগুড়া নগরীর একেবারে কেন্দ্রস্থলে প্রধান ডাকঘরে প্রবেশের পর হাতের বাঁয়ে তাকালেই চোখে পড়বে একটি বাঁশঝাড়। তবে বাঁশগুলো বেশি লম্বা নয়। দেশে বাঁশের ৩৩টি জাতের মধ্যে এই বাঁশ একটি। বাঁশের গিটাগুলো খুব কাছাকাছি। অনেকে বলে অর্নামেন্টাল ব্যাম্বো। বেঁটে (বামুন) এই বাঁশ দেখতে সুন্দর। পাতার পরিমাণ বেশি। ছায়া দেয়। রোদের তাপ শোষণ করে শীতল করে। রোদে কাহিল হয়ে কেউ বাঁশ গাছের তলায় ক্ষণিক বসে শরীর জুড়িয়ে নেয়। বাঁশ উদ্ভিদ নয়। বাঁশ একধরনের ঘাস বা ঘাসের একটি জাত। উদ্ভিদের মর্যাদা পায়নি। মানুষকে বিব্রত করতে ও গালি দিতে বাঁশের ব্যবহার আদিকালের। যতই গালি দেয়া হোক বাঁশ জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বাঁশকে বলা হয় গরিবের কাঠ। নিশুতি রাতে বাঁশের বাঁশির মোহনীয় সুর মানব হৃদয়ে স্বর্গীয় ভাব এনে দেয়। পৌরণিক উপাখ্যানে- নীপবনে কৃষ্ণের বাঁশির সুর রাধাকে ঘর থেকে বের করে এনেছিল। ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ মাগো আমার শোলক বলার কাজলা দিদি কই..” কিংবদন্তি হয়ে আছে কবিতাটি। সেই বাঁশ বাগানের মাথার ওপর এখন চাঁদ দেখা যায় কালে ভদ্রে। বাঁশ বাগান উজাড় করে নির্মিত হচ্ছে অবকাঠামো। অতীতে গ্রামীণ জীবনে বাঁশঝাড় ছিল কোন বাড়ির পরিচিতির সূচক। গ্রামের লোক আজও বাঁশের আড়া বলে। অতীতে রাতে বাঁশঝাড়ের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় গা ছম ছম করে উঠতো। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে বাঁশের ঠোকাঠুকিতে একধরনের ধ্বনি হয়। মনের ভয় তাড়া করে। জীবনের সকল অধ্যায়ে বাঁশ বন্ধু হয়ে আসে। বলা হয় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বাঁশের প্রয়োজন। দুর্যোগ মোকাবেলা, ভূমিক্ষয় রোধ, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখে বাঁশ। বাঁশ অন্যান্য গাছগাছালির চেয়ে বেশি পরিমাণে অক্সিজেন উৎপাদন এবং বেশিমাত্রায় কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে। নব্বইয়ের দশকে কুড়িগ্রামের উলিপুরে বাঁশে তৈরি পাইপে পায়ে চালিত (ট্রেডেল) সেচ নলকূপ উদ্ভাবিত হয়। গ্রামে লোকজন ছোট খাল পার হতে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁশ দিয়ে সেতু বানায়। বন্যার সময় আশ্রয়ে বাঁশ দরকার। অবকাঠামো নির্মাণ, পাকা বাড়ির ছাদ ঢালাইয়ের আগে সাটারিংয়ে, নির্মাণের পর বাইরে প্লাস্টার ও রং করতে বাঁশ লাগবেই। গ্রামে কাঁচা ঘর নির্মাণ, তোরণ, প্যান্ডেল তৈরি, কোন কিছু ঠেকান দিতে, ঘরের খুঁটি, বেড়া, চাটই, ঘর গেরস্থালি কুলা, ডালা, ঝুড়ি অন্যান্য সামগ্রী, কুটির শিল্প সামগ্রী বানাতে বাঁশের দরকার। বাঁশে তৈরি হস্তশিল্প পরিবেশবান্ধব যা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। বাঁশের মন্ড থেকে বস্ত্র শিল্পের তুলা ও সুতা তৈরি হচ্ছে। কাগজ কলের মন্ড তৈরির কাঁচামাল বাঁশ। বিদেশে প্রাকৃতিক চিকিৎসায় ব্যাম্বো ম্যাসেজ থেরাপি সেন্টার গড়ে উঠছে। হালে বিভিন্ন ধরনের ভেষজ ওষুধেও ব্যবহার হচ্ছে বাঁশ। খাদ্য হিসাবেও বাঁশ এগিয়ে এসেছে। পুষ্টি বিজ্ঞানীগণ বলছেন, কচি বাঁশের নরম কান্ড (বাঁশ কড়াল) খাদ্যগুণ ও মুখরোচক স্বাদের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় খাদ্য তালিকায় সবজি হিসাবে বড় আসন করে নিয়েছে। পার্বত্য এলাকার পাহাড়ী লোকজনের কাছে বর্ষা মৌসুমের স্বাদের খাবার বাঁশের কান্ড। দুধের মধ্যে বাঁশ পাতা রেখে অনেকক্ষণ টাটকা রাখা যায়। বিশ্ব এগিয়ে যাওয়ার পালায় বড় ভূমিকা রাখছে বাঁশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাঁশের প্রজাতি ও বৈচিত্র্যের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম। প্রথম স্থানে আছে চীন। বাংলাদেশে বাঁশের প্রজাতি ৩৩। তবে কারও মতে ২৭। দেশী প্রজাতির বাঁশের মধ্যে রয়েছে মুলি, তল্লা, বরাক, ভুদুম, বেথুয়া, বাইজ্জা, লতা, ফারুয়া, করজবা, মাকলা ইত্যাদি। বাঁশগুলোর কোনটির কান্ড পুরু, কোনটির লতানো, কোনটি ঘন আচ্ছাদন। তল্লা মাকলা ভুদুম বাঁশের কান্ড পুরু ও কাষ্ঠল হওয়ায় নলকূপের পাইপ, গ্রামীণ সাঁকো, ইমারত তৈরিতে ছাদ দেয়ার আগে ব্যবহার হয়। দেশে বছরে শুকনো বাঁশের চাহিদা অন্তত ১০ লাখ টন। বাঁশ প্রজাতিকে রক্ষা এবং বৈচিত্র্য সংরক্ষণে চট্টগ্রামের ষোলশহরে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) সিলভি কালচার জেনিটিকস বিভাগের অধীনে বাঁশ উদ্যান গড়ে তোলা হয়। সেখানে দেশীয় বাঁশের পাশাপশি বিদেশ থেকে আনা কয়েকটি জাতের রেপ্লিকা হয়েছে। ২ হাজার ১০ সালে চীনের বাঁশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশের মুলি বাঁশ সংরক্ষণ করে ওদের একটি প্রজাতি দেয়। ২ হাজার ৮ সালে চট্টগ্রামের ওই কেন্দ্র মধুপুর অঞ্চলে ১০ হাজার বাঁশের চারা দিয়েছে। বিএফআরআই ৩৩ জাতের বাঁশ সংরক্ষণ করেছে। জলবায়ু সহিষ্ণু ৬টি নতুন জাতের বাঁশ উদ্ভাবন করেছে। এরমধ্যে ২টি জাতের বাঁশের কান্ড সবজি হিসাবে খাওয়া যাবে। জলবায়ু সহিষ্ণু দেশের আবহাওয়া উপযোগী শীঘ্রই আরও নতুন কয়েকটি জাত উন্মুক্ত করা হবে। যা পাহাড় ধস, ভূমিক্ষয় নদী ভাঙ্গন রোধে ভূমিকা রাখবে। হারিয়ে যাওয়া বাঁশের বীজের একটি জার্মপ্লাজম সংরক্ষণাগার নির্মিত হয়েছে। বিএফআরআইয়ের বাঁশ উদ্যানে টিস্যু কালচারেও চারা তৈরি হচ্ছে। বাঁশ দ্রুত বর্ধনশীল। ২০ থেকে ৫০ ফুট লম্বা বাঁশের সংখ্যা বেশি। চারা রোপণের পর ৫ বছরেই পূর্ণাঙ্গ বাগানে পরিণত হয়। বাঁশের বৃদ্ধি হয় দুই ভাবে। ১. বীজ ২. অঙ্গজ। ঝাড়ের বাঁশে ২৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ফুল ধরে। এ সময় অনেক বীজ মাটিতে পড়ে। সেখান থেকে চারা গজায়। প্রাকৃতিক নিয়মেই বাঁশের গোড়া বা মাথা থেকে চারা বের হয়ে ঝাড় সৃষ্টি হয়। যাকে বলা হয় অঙ্গজভাবে বাঁশ তৈরি। এই পদ্ধতিতে বাঁশঝাড় বেড়ে ওঠে। লোকজন বলে মোথা পদ্ধতি। সকল প্রজাতির বাঁশে শুরুতে কঞ্চি গজানো শুরু হয়। প্রতিটি বাঁশেই থাকে অনেকগুলো গিট। লোকজন বলে গিট্যা। বাঁশ ব্যবহারের আগে ওপরে গিটে ছেঁটে ফেলতে হয়। বাঁশের কঞ্চি যত চিকনই হোক এর আঘাত কম নয়। বাঁশ উদ্ভিদের পরিচয় পাক আর নাই পাক এই জীবনের প্রয়োজনে কি শহরে কি গ্রামে বাঁশ না হলেই নয়।
×