ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল

প্রকাশিত: ১৩:৪৪, ২৯ এপ্রিল ২০২১

আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল

নিজস্ব সংবাদদাতা, বাঁশখালী ॥ আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল। ১৯৯১ সালের এই দিনে ম্যারি এন নামক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দেয় দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার পুরো উপকূল। সেখানে রক্ষা পায়নি চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী এলাকা বাঁশখালী উপজেলাও। রাতের নিস্তব্ধতা ও অন্ধকার ভেদ করে মুহুর্তের মধ্যে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকায় গুলো। বাঁশখালীর উপকূলীয় এলাকা ছনুয়া, গন্ডামারা, বাহারছড়া, খানখানাবাদ, প্রেমাশিয়া, সাধনপুর, পুকুরিয়ায় এই ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল ভয়ংকর রূপে। এলাকা গুলো পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তুপে। মাইলের পর মাইল পড়েছিল মানুষ ও গবাদি পশুর মৃতদেহ। মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিল প্রকৃতির ভয়াবহ এই তান্ডব। পরদিন দেশবাসী অবাক হয়ে গিয়েছিল সেই ধ্বংসলীলা দেখে। দেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় গুলোর মধ্যে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে নিহতের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশী। ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল রাতে আঘাত এই ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় প্রায় ১৮০-২০০ কি.মি. (১৪০ মাইল/ঘন্টা)। প্রলংয়ঙ্করী এই ঘূর্ণিঝড় এবং তার প্রভাবে সৃষ্ট ৬ মিটার (২০ ফুট) উঁচু জলোচ্ছাসে বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলবর্তী জেলা গুলোতে প্রথম ধাক্কায় মৃতের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৬৬ জন। মারা যায় ২০ লাখের অধিক গবাদি পশু। গৃহহারা হয়েছিল প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ। তৎমধ্যে বাঁশখালীতেও প্রায় ১২ হাজারের অধিক মানুষ প্রাণ হারায়। এই ঘূর্ণিঝড়ে কেউ কেউ বাবা, মা আবার কেউ কেউ ভাই বোনসহ স্বজনদের হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল। বাঁশখালীর উপকূলীয় ছনুয়া এলাকায় আজ বৃহস্পতিবার (২৯ এপ্রিল) সকালে স্বামী ও স্বজনহারা ষাটার্ধ্বো বিধবা কুলছুমা বেগমের সাথে কথা বলে ৯১ এর সেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব কত যে ভয়ংকর ছিল তার কিছুটা হলেও ধারণা লাভ করা যায়। এই প্রতিবেদকের সাথে তিনি এখনো স্বামী ও স্বজন হারা বেদনা নিয়ে অশ্রুজলে বর্ণনা দিয়েছেন। সেই রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে কুলছুমা বেগম কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। অপরদিকে একই ভাবে ঘটে যাওয়া প্রাণঘাতি এই দুর্যোগে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া মহেশখালীসহ এমন বহু পরিবার আছে যাদের এখনও পর্যন্ত কোন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞানীরা অনেকে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য গ্লোবাল ওয়ামিং বা বৈশ্বিক উঞ্চায়নকে দায়ী করেছেন। ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রের তাপমাত্রা ১৯৭০ সালের পর প্রায় এক ডিগ্রী ফরেনহাইট বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা এই এক ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে এখন আগের চেয়ে শক্তিশালী এবং বেশী সংখ্যায় ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে। এই ধরনের ঝড়ে বাতাস প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে ছুটে চলে বলে এর নামকরণ হয়েছে ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড়ের ঘুর্ণন উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাটার দিকে। ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানলে যদিও দূরারোগ্যের সৃষ্টি হয়, কিন্তু এটি আবহাওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা পৃথিবীতে তাপের ভারসাম্য রক্ষা করে। গড়ে পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ৮০টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। এর অধিকাংশই সমুদ্রে মিলিয়ে যায়, কিন্তু যে অল্প সংখ্যক ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানে ভয়াবহ ক্ষতি সাধন করে তার একটি ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় “ম্যারি এন”। বাংলাদেশ তথা উত্তর ভারত মহাসাগর এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয় না। তার পরিবর্তে আরব সাগর এলাকায় উৎপন্ন ঝড়গুলোকে ‘এ’ এবং বঙ্গোপসাগরে উৎপন্ন ঝড় গুলোকে ‘বি’ অক্ষর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল যে ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হেনেছিল তার পরিচয় টিসি-০২বি হিসেবে, তার মানে এটি ছিল ১৯৯১ সালে বঙ্গোপসাগরে উৎপন্ন দ্বিতীয় ঘূর্ণিঝড়। ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল ভয়ংকর এই ঘূর্ণিঝড়ে আনুমানিক প্রায় ৫ লক্ষ লোক নিহত হয়েছিল তথা বাঁশখালীতে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ‘ম্যারি এন’ নামক এই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায়। আর এতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় পুরো উপকূল। ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয় কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ। প্রলয়ঙ্করি এই ধ্বংসযজ্ঞের ২৫ বছর পার হয়েছে আজ। এখনো স্বজন হারাদের আর্তনাদ থামেনি। ঘরবাড়ি হারা অনেক মানুষ এখনো মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে পারেনি। কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী, সীতাকুণ্ড, সন্দ্বীপ, আনোয়ারা উপকূলবাসীসহ সারা বাংলাদেশের মানুষকে সেই ভয়াবহ স্মৃতি স্বজন হারানোর বেদনা আজও অশ্রু ভারাক্রান্ত করে তুলে। স্মরণকালের ভয়াবহ এ ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ২৫০ কিলোমিটার। ২০ ফুট উঁচু জ্বলোচ্ছাসে তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। দেশের ১৫টি উপকূলীয় জেলায় দেড় কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস। এর মধ্যে ১ কোটি লোক ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছাসে এখনো অরক্ষিত। বর্তমানে বাঁশখালীর ১১৭টি সাইক্লোন সেল্টার থাকলেও অধিকাংশ জ্বরাজীর্ণ ও ব্যবহার অনুপযোগী। এখন যদি সেই ১৯৯১ সালের মত বড় ধরনের কোন “ম্যারি এন” আঘাত হানে তাহলে মানুষের আশ্রয় নেওয়ার মত তেমন সুযোগ থাকবে না। উপকূলীয় এলাকায় ঘনঘন প্রাকৃতিক দুযোর্গ থাকলেও এসব এলাকার জননিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। তাদের সুরক্ষার জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপই নেয়া হচ্ছে না। বেড়িবাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলেও এখনো কাজের অগ্রগতি দেখা যায় না। তাই সচেতন মহল এই বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজের অগ্রগতি ও উপকূল রক্ষার জন্য উদ্যোগ গ্রহণের দাবী জানান।
×