
ছবি: সংগৃহীত
বাতাস থেকে একফোঁটা পানিও বের করা কঠিন—বিশেষত মরুভূমি বা শুষ্ক এলাকায়, যেখানে আর্দ্রতা খুবই কম। অথচ, যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক সম্প্রতি এমন এক বিস্ময়কর পদার্থ আবিষ্কার করেছেন, যা কোনো রকম বিদ্যুৎ, ফিল্টার বা অতিরিক্ত যন্ত্রপাতি ছাড়াই বাতাস থেকে পানি সংগ্রহ করতে পারে। এবং এটি হয়েছে একেবারেই 'দুর্ঘটনাবশত'!
এই উদ্ভাবন, যা বিজ্ঞানীদেরও চমকে দিয়েছে, ভবিষ্যতে পানির জন্য হাহাকার করা অঞ্চলগুলোতে জীবন রক্ষাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে।
কীভাবে কাজ করে এই ‘জাদুকরী’ পদার্থ?
এই পদার্থের কার্যপ্রণালী নির্ভর করে এক বিশেষ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ওপর, যার নাম ক্যাপিলারি কনডেনসেশন। সাধারণভাবে, পানি বাষ্প থেকে তরলে রূপান্তরিত হয় উচ্চ আর্দ্রতা ও ঠান্ডা পরিবেশে। কিন্তু এই পদার্থের মাইক্রোস্কোপিক বা ন্যানোস্তরের ছিদ্রগুলোতে এমন একটি বিশেষ কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, যেখানে কম আর্দ্রতাতেও বাষ্প তরলে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
এখানে ব্যবহৃত হয়েছে দুটি বিপরীত বৈশিষ্ট্যের উপাদান—একটি হাইড্রোফিলিক (পানিপ্রেমী), অপরটি হাইড্রোফোবিক (পানিবিরোধী)। এই সংমিশ্রণ পানির বাষ্পকে আকর্ষণ করে এবং এক পর্যায়ে ছোট ছোট ফোঁটারূপে সেটিকে উপরে উঠিয়ে আনে। বিস্ময়কর বিষয় হলো, ঐ পানি কেবল ভেতরে আটকে থাকে না, বরং নিজে থেকেই পদার্থটির পৃষ্ঠে উঠে আসে এবং দৃঢ়ভাবে স্থায়ী ফোঁটা তৈরি করে।
পদার্থবিজ্ঞানের প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ
গবেষকরা লক্ষ্য করেন, সাধারণত ন্যানোছিদ্রযুক্ত পদার্থে পানি প্রবেশ করলে তা আটকে যায় এবং সহজে বের হয় না। কিন্তু নতুন আবিষ্কৃত পদার্থে পানি নিজে থেকেই ওপরে উঠে আসে এবং সেখান থেকে সহজেই সংগ্রহযোগ্য হয়।
পরীক্ষার অংশ হিসেবে যখন পদার্থটির পুরুত্ব বাড়ানো হয়, তখন দেখা যায় পানি সংগ্রহের হারও বেড়েছে—যা নিশ্চিত করে যে পানি সত্যিই ভেতর থেকেই উঠে আসছে। আরও চমকপ্রদ তথ্য হলো, এসব পানির ফোঁটা দীর্ঘ সময় ধরে বাষ্পীভবন ছাড়াই স্থির থাকে।
ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে দেখা যায়, কীভাবে পদার্থটির ন্যানোছিদ্র পানির ফোঁটা তৈরি করে এবং আবার সেগুলো পুনরায় পূরণ করে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা: মরুভূমি থেকে মাইক্রোচিপে
এই আবিষ্কারের ভবিষ্যৎ প্রয়োগ নিয়ে গবেষকরা ভীষণ আশাবাদী। যেহেতু এটি সম্পূর্ণভাবে প্যাসিভ পদ্ধতিতে কাজ করে (অর্থাৎ কোনো বিদ্যুৎ বা যন্ত্রপাতির প্রয়োজন পড়ে না), তাই সহজেই এটি ব্যবহার করা যেতে পারে—
মরুভূমি বা পানিশূন্য অঞ্চলে পানি সংগ্রহে,
বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির কুলিং সিস্টেমে,
এমনকি এমন স্মার্ট কোটিং তৈরিতে, যা বাতাসের আর্দ্রতা বুঝে নিজেই পানি সংরক্ষণ করতে পারে।
এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন ড. ডায়িওন লি ও ড. আমিশ প্যাটেল। তাদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেছে টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখের গবেষকরাও। তারা মনে করেন, বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের আন্তঃবিভাগীয় সহযোগিতা ভবিষ্যতের জটিল সমস্যাগুলোর সমাধানে সবচেয়ে কার্যকর।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
যদিও এই পদার্থের কার্যক্ষমতা চমৎকার, কিন্তু একে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে আসবে। যেমন—পরিবেশগত স্থায়িত্ব, ব্যয়বহুল না হয়ে ওঠা, ও বড় পরিসরে উৎপাদনের সক্ষমতা। তবে গবেষকরা আশাবাদী যে এর সহজ উৎপাদনপ্রণালী—সাধারণ পলিমার ও ন্যানোপার্টিকল ব্যবহারের মাধ্যমে—এর বিস্তৃত ব্যবহারে সহায়ক হবে।
এই অসাধারণ উদ্ভাবন আবারও দেখিয়ে দিল, বিজ্ঞান কখন কীভাবে অপ্রত্যাশিতভাবে সামনে এসে দাঁড়ায়, তার কোনো পূর্বাভাস থাকে না। প্রশ্ন হলো, এই পদার্থ কি ভবিষ্যতের পানি সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় আমাদের সত্যিকারের মুক্তির পথ দেখাবে?
সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মুক্ত, আর গোটা দুনিয়া তাকিয়ে আছে এই জাদুকরী পদার্থের ভবিষ্যৎ যাত্রার দিকে।
এসএফ