ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শাড়ি-জামা থেকে এখন গাড়িতে গিয়েও ঠেকেছে

ঈদ অর্থনীতির কর্মকাণ্ড বেড়েছে

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ২৪ জুন ২০১৭

ঈদ অর্থনীতির কর্মকাণ্ড বেড়েছে

এম শাহজাহান ॥ একদিন বাকি থাকতে শেষ মুহূর্তে কেনাকাটার ধুম পড়েছে ঈদ বাজারে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন রাজধানীর মার্কেটগুলোতে ছিল উপচেপড়া ভিড়। এ বছর কেনাকাটা বাড়ায় ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতির কর্মকা- বেড়েছে। ঈদের অর্থনীতিও বেড়েছে। ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতির বিস্তার এখন শাড়ি-জামা থেকে শুরু করে গাড়িতে গিয়েও ঠেকেছে। এদিকে নাড়ির টানে যারা বাড়ি যাচ্ছেন ও যাবেন তারা শুক্রবার সকালেই বেরিয়ে পড়েন মার্কেটের উদ্দেশে। কেনাকাটার চাপ সামলাতে বিক্রেতাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ঢাকার ব্যস্ততম রাস্তাগুলো অন্য সময়ের চেয়ে কিছুটা ফাঁকা থাকলেও মার্কেটগুলোর সামনে যানজট ও ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। যারা ঢাকায় ঈদ করবেন তাদের কেনাকাটা এখন চলছে পুরোদমে। মার্কেট সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছরে মানুষের আয় বেড়েছে। আয় বাড়লে মানুষের ভোগব্যয় বাড়তে থাকে। দেশের প্রধান ধর্মীয় এই উৎসবে সাধ্যমতো সবাই কেনাকাটা করেন। এছাড়া স্বল্প আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশ নিম্নমধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে মানুষের। এতে করে বেড়েছে কেনার সামর্থ্যও। আর এই কেনার সামর্থ্যকে পুঁজি করে বেড়ে গেছে ঈদকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ। ফুলে ফেঁপে উঠছে অর্থনীতিও। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এসএ কাদের কিরণ জনকণ্ঠকে বলেন, এ বছর ঈদের কেনাকাটা বেড়েছে। বিক্রি বেড়েছে প্রায় ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সরকারী কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বাড়ার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে ঈদ বাজারে। তিনি বলেন, ঈদ বোনাসের পাশাপাশি এখন পহেলা বৈশাখের উৎসব ভাতা দেয়া হচ্ছে। এবারের বৈশাখী যে ভাতা দেয়া হয়েছে সেই টাকা এখন ঈদ বাজারে এসেছে। কারণ ওই সময় বেচাবিক্রিতে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। কিন্তু এবার ঈদের বেচাবিক্রি বলে দিচ্ছে মার্কেটে বাড়তি টাকা এসেছে। জানা গেছে, যে কোন উৎসবে দেশে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। বিশেষ করে শবেবরাত, রোজা, ঈদ ও পহেলা বৈশাখ কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক কর্মকা- কয়েকগুণ বাড়ে। আর এই টাকার বড় অংশ ব্যয় হয় খাবার-দাবার, পোশাক-আশাক ভ্রমণ, ভোগবিলাস ও প্রসাধনীতে। ঈদের অর্থনৈতিক কর্মকা- এতদিন পোশাক, খাবার আর জুতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন মানুষ ঘরের আসবাবপত্র, ফার্নিচার সামগ্রী, ইলেক্ট্রনিক পণ্য ও নতুন গাড়ি পর্যন্ত কিনছেন। একইভাবে মানুষ ঈদ উপলক্ষে একে অন্যকে উপহার দিচ্ছে বা পাঠাচ্ছে। ঈদকে কেন্দ্র করে অনলাইনে ব্যবসাও (ই-বিজনেস) বেড়েছে। এই উৎসবকে মানুষজন পরিবার পরিজন নিয়ে দেশ-বিদেশে ভ্রমণেও যাচ্ছেন। আয় বাড়ায় মানুষ সাধ্যমতো কেনাকাটা করছেন। এতে করে দেশে টাকার প্রবাহ বাড়ছে। ঈদ অর্থনীতিতে যেসব খাত থেকে অর্থের যোগান সবচেয়ে বেশি হয় সে খাতগুলো হচ্ছে-সরকারী বেসরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাস, প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিটেন্স, মানুষের জমানো আয়, রাজনৈতিক নেতাদের দান অনুদান বা ঈদ বখশিশ, মানুষের জাকাত-ফিতরা। রোজা ও ঈদকে কেন্দ্র করে চাঙা হওয়া শহর ও গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোয় উৎপাদিত পণ্যের বিক্রিত অর্থ, মৌসুমী ফল বিক্রির অর্থ, ব্যাংকগুলোর ছাড় করা কৃষি ঋণ, সরকারী দান অনুদানের অর্থ যুক্ত হয় ঈদ অর্থনীতিতে। ঈদ অর্থনীতির বেশিরভাগই ব্যয় হয় গ্রামে। এই সময়টাতে শহরের তুলনায় গ্রামে টাকার প্রবাহ বাড়ে। চাঙা হয় গ্রামীণ অর্থনীতি। ঈদের এই অর্থনীতির বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সম্প্রতি জানান, মানুষের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভোগ্যপণ্যের চাহিদায়ও বৈচিত্র্য এসেছে। ঈদের অর্থনৈতিক কর্মকা- এতদিন পোশাক আর জুতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন মানুষ ইলেক্ট্রনিক পণ্য থেকে গাড়ি পর্যন্ত কেনাকাটা করছেন। এমনকি দেশে-বিদেশে ভ্রমণেও যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ঈদের অর্থনীতির আকার যা-ই হোক না কেন, দেশের ভেতরে এর মূল্য সংযোজন কতটুকু, সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ অনেক পণ্যই এ উপলক্ষে আমদানি হয়ে আসে। তবে ঈদকে ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকা-ের বিস্তৃতি ঘটায় শহর ও গ্রামে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতির বড় অংশজুড়েই পোশাকেরই রাজত্ব। ঈদকেই কেন্দ্র করেই দেশে গড়ে উঠেছে ফ্যাশন হাউসকেন্দ্রিক বেশ বড় দেশীয় পোশাকশিল্প। দেশে সাড়ে চার হাজারের মতো ফ্যাশন হাউস আছে। এর বেশিরভাগই ঢাকা ও চট্টগ্রামে অবস্থিত। প্রতিটি ফ্যাশন হাউসে এখন বেচাবিক্রির ধুম পড়েছে। র‌্যাঙ্কিন স্ট্রিটের আড়ংয়ের বিক্রয় কর্মকর্তা ফারহানা ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ঈদ উপলক্ষে আড়ং এবার শাড়ি-থ্রিপিস ও পাঞ্জাবির পাশাপাশি সব ধরনের পোশাক-আশাক বিক্রি করছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের শো-পিস আনা হয়েছে। তিনি বলেন, এই ঈদে সব ধরনের পণ্যেরই বাড়তি চাহিদা থাকে। গতবারের মতো এবারও ভাল বিক্রি হচ্ছে। জানা গেছে, সালোয়ার-কামিজ, শার্ট-প্যান্ট, বোরকা, শাড়ি-লুঙ্গির কাপড় থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের থান ও গজ কাপড়ের সম্ভার ইসলামপুর এখন দেশের বৃহত্তম কাপড়ের বাজার। ইসলামপুর বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির নিবন্ধিত ছোট-বড় দোকানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার। এর বাইরে আছে আরও দুই হাজার ছোট-মাঝারি দোকান রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে পুরান ঢাকার ইসলামপুর মার্কেট এখন জমজমাট। সারারাত ধরে বেচাবিক্রি চলছে। গুলশানের কেনাকাটা জমজমাট গুলশানের অভিজাত ফ্যাশন হাউস জারা, ভাসাবি, মাত্রা ও আলমাসে এখন কেনাকাটার ধুম পড়েছে। রাত যত বাড়ে গুলশান এলাকার মার্কেটগুলো যেন ততটাই জমে উঠে। অভিজাত এসব ফ্যাশন হাউস ও শপিংমলের বেশিরভাগ পণ্য দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা হয়েছে। ধনাঢ্য শ্রেণীর ক্রেতাদের কথা চিন্তা করে ফ্যাশন হাউসগুলো সেভাবেই সাজানো হয়েছে। কিন্তু এখানকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, অভিজাত শ্রেণী এবার দেশের বাইরে যেয়ে কেনাকাটা করছেন। এ কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্রেতারা তাদের ভরসা হয়ে উঠছে। তারা বলছেন, বিভিন্ন দেশের ভিসা প্রক্রিয়া সহজ হওয়ায় ক্রেতারা সহজেই ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে যেয়ে কেনাকাটা করতে পারছেন। সবচেয়ে বেশি যাচ্ছে কলকাতায়। এতে করে তারা ক্রেতা হারাচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শপিংমল এ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি মোঃ শফিকুল ইসলাম ভরসা জনকণ্ঠকে বলেন, ক্রেতাদের কথা চিন্তা করে সব ধরনের পণ্য তারা সংগ্রহ করেছেন। ভ্যাট ও ট্যাক্স দিয়ে এসব পণ্য বাইরে থেকে আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু ধনাঢ্য শ্রেণীরা ক্রেতারা বাইরে যেয়ে ঈদ শপিং করছেন। এতে তারা ক্রেতা হারাচ্ছেন। ভবিষ্যতে এই অবস্থা চলতে থাকলে ফ্যাশন হাউসগুলোর বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। জানা গেছে, জারা ফ্যাশন হাউসে আড়াই হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা দামের পাঞ্জাবি এবং ৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৩ লাখ টাকা দামের শাড়ি বিক্রি করা হচ্ছে। এখানে রেডিমেড গাউন এবং মোম্বে টেস্টের পাঞ্জাবি সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। ঈদে বিদেশী মৌসুমী ব্যবসায়ীদের আনাগোনা ঈদ সামনে রেখে রোজার শুরুতেই রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিদেশী মৌসুমীরা ভিড় করেছে। পাকিস্তান, ভারত, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডের এসব ব্যবসায়ীরা ঈদ মার্কেটে চুটিয়ে ব্যবসায় করছেন বলে জানা গেছে। গুলশান, বারিধারা, বনানী এলাকার অভিজাত ফ্ল্যাট ও বাড়ি ভাড়া করে তারা বিভিন্ন মার্কেট ও শপিংমলে পণ্যের যোগান দিচ্ছেন। এমনকি ফ্ল্যাট থেকেও দামি শাড়ি, গাউন ও পাঞ্জাবি বিক্রি করা হচ্ছে। এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক মোঃ শফিকুল ইসলাম ভরসা আরও জানান, ভবিষ্যতে মৌসুমী ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে এদেশীয় ব্যবসায়ীরা আর ব্যবসা করতে পারবেন না। শপিংমল ও ফ্যাশন হাউসের ব্যবসা থেকে অনেকে সরে পড়বেন।
×