ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

রঙে রঙিন যাপিত জীবন

শিউলী আহমেদ

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

রঙে রঙিন যাপিত জীবন

‘দৈনিক জনকণ্ঠ’- নিশ্বাসের সঙ্গে মিশে থাকা একটি নাম

‘দৈনিক জনকণ্ঠ’- নিশ্বাসের সঙ্গে মিশে থাকা একটি নাম। জন্মলগ্ন থেকেই তার সঙ্গে আমার পরিচয়। এক যুগ ধরে ছুঁয়ে আছি তাকে। আর সবচেয়ে আলোড়িত যে অংশটুকু, যা ছোট-বড় প্রায় সবার খুব প্রিয়- সেই পাতার সঙ্গেই প্রায় দুই বছর যাবত আমার মিতালী। ‘যাপিত জীবন’- জীবনের যত রং সবটুকু যেন মিলেমিশে একাকার এই ফিচার পাতায়।

বর্তমানে প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় এমন একটি ফিচার পাতা তাদের নিজস্ব নামে প্রচলিত থাকলেও, এই পাতার সূচনা হয় দৈনিক জনকণ্ঠ থেকেই। তার আগে কোনো পত্রিকায় ছিল না এই অংশ। একযোগে রঙিন হয়ে ৪টি বিভাগ থেকে প্রকাশ হওয়া ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ সূচনালগ্ন থেকেই ছিল সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ একটি পত্রিকা। অনেকগুলো ফিচার পাতা নিয়ে প্রকাশিত দৈনিকটি পুরো দেশে সাড়া জাগিয়ে ছিল সে সময়। কারণ তখন ঢাকার বাইরে বেশির ভাগ শহরে দৈনিক পত্রিকা যেত একদিন পর। জনকণ্ঠই প্রথম সেই ধারায় পরিবর্তন আনে। দিনের পত্রিকা দিনেই চলে যেত প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাঠকের হাতে। 
জীবনযাপনের প্রায় প্রতিটি বিষয় নিয়ে আলোচনা থাকায় ‘যাপিত জীবন’ প্রথম থেকেই সবার মনে জায়গা করে নেয়।
তখন এত ব্যাপক হারে সবাই ফ্যাশন বা সৌন্দর্য সচেতন ছিল না। এই পাতাটিই যেন একসঙ্গে দেশের প্রায় সকলকে বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীদের নিজেদের সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন করে তোলে। দৈনন্দিন জীবনকে সুন্দর করে রাঙিয়ে দিতে ‘যাপিত জীবন’ পাতাটি সবার মাঝেই বিরাট ভূমিকা রেখেছিল তখন। গৃহসজ্জা, পোশাক-আশাক, জায়গা বা অনুষ্ঠানভেদে সাজের রকমভেদ সবই থাকত এই পাতায়। তখন আজকের মতো স্যাটেলাইট আর মোবাইল-ইন্টারনেট ছিল না।

পত্রিকা আর একমাত্র টিভি চ্যানেল বিটিভি ছিল খবরা-খবরের একমাত্র মাধ্যম। সে সময় আধুনিকতার পথ পাওয়া যেত পত্রিকাতেই। বিভিন্ন ধরনের রান্নার রেসিপি, ত্বকের যতœ, চুলের যতœ, জীবনকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা, সব জায়গায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে কিভাবে জটিল পরিস্থিতিতেও হাসিমুখে-নির্ঝঞ্জাটভাবে পথচলা যায় ইত্যাদি বহুবিধ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়ে, অগণিত পাঠকের মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছিল ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’র এই ফিচার পাতা ‘যাপিত জীবন’।
দৈনিক জনকণ্ঠ আমার জীবনেও এক বিস্ময়। ‘শিক্ষা সাগর’ পাতাটির বদৌলতে জন্মলগ্ন থেকেই ঘরে আসতে থাকে জনকণ্ঠ। 
কখনো ভাবিনি আমি নিজে কোনোদিন এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হব। একদিন আবিষ্কার করলাম, আমি তো সেই জনকণ্ঠে! যেখানে আমার প্রিয় সাংবাদিকগণও আছেন! যা না বললেই নয়, জনকণ্ঠের বগুড়ার রিপোর্টার ‘সমুদ্র হক’ ছিলেন আমার খুব প্রিয় একজন লেখক। পত্রিকা হাতে নিয়েই যার লেখা আমি এক নিশ্বাসে পড়ে শেষ করতাম। এখানে এসে সেই প্রিয় মানুষটির সাক্ষাৎ পেয়ে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।

গত ১৪ নভেম্বর ২০২৩ তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে বিশাল একটা পরিতৃপ্তি-শৈশবের সেই প্রিয় অধ্যায়টি আজ আমার হাতে, আমার দায়িত্বে প্রকাশিত হয়! সেখানে আমারও লেখা থাকে! এমন আরও অনেক বিস্ময় মিশে আছে আমার এই জনকণ্ঠের সঙ্গে। বিভিন্ন দিবসে মানুষের মনের সুপ্ত ভাবনাগুলো এই যাপিত জীবনেই প্রকাশ হয়।

বাবা দিবস, মা দিবস, বৈশাখ, ফাল্গুন, ভ্যালেন্টাইনস ডে- উদ্যাপনসহ কি পোশাক পরবে, কিভাবে সাজবে, এমনকি কোথায় যাওয়া যেতে পারে- এসব বিষয়ে এই ফিচার পাতায় অনেক রঙিন আয়োজন করত! দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। সে সময় ২১ ফেব্রুয়ারি ছাড়া বইমেলা, পয়লা ফাল্গুন, ভ্যালেন্টাইন্স ডে সেভাবে ঘটা করে পালিত হতো না। খুব পড়ুয়া ব্যক্তি ছাড়া তেমন কেউ বইমেলায়ও যেতেন না। পত্রিকার এই সুন্দর, সাজানো- গোছানো উপস্থাপন, আর উৎসাহ মানুষকে বই মেলামুখী করে।

ঘরোয়াভাবে বা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে উদ্যাপন করা দিনগুলোও জাঁকজমকভাবে উদ্যাপিত হতে থাকে এই ফিচার পাতার বদৌলতেই। বাঙালি উৎসব প্রিয়, ১২ মাসে তার তেরো পার্বণ। এই দিবসগুলো বাঙালিকে রাঙিয়ে দিয়ে উৎসবমুখর করে তোলে। তার চেয়ে বড় কথা ভালোবাসা দিবস, মা দিবস, বাবা দিবসÑ এসব দিবসগুলো আমাদের দেশে তেমন প্রচলিত ছিল না। এই বহির্প্রকাশের মাধ্যমটাও জানা গেছে যাপিত জীবনের মাধ্যমেই।

এই সুযোগে মনের গোপন কথাটার বহির্প্রকাশ ঘটে। মুখে না বলে, প্রিয় মানুষটিকে তার পছন্দের জিনিস উপহার দিয়েও ভালোবাসার কথা জানানো যায়। সেই উপহার কেমন হতে পারে, সেই বিষয়গুলো সুন্দরভাবে তুলে ধরে মানুষের এসব সুপ্ত ইচ্ছাগুলো যাপিত জীবনে সুন্দরভাবে উপস্থাপন হতো। সাজ-পোশাকের প্রতি আগ্রহ মানুষ তখন থেকেই বেশি প্রকাশ করে।
চলছে ফাগুন মাস। প্রকৃতিতে ফাল্গুনী হাওয়া বইছে। মৃদু মন্দ শীতল মিষ্টি বাতাসের সঙ্গে রুক্ষ্ম প্রকৃতি এ সময় মানুষকে কিছুটা উদাসীন আর বিষাদগ্রস্তও করে তোলে। ২১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আমাদের জন্য খুশির দিন। এই খুশির আড়ালে একটা বিষণœতাও বিরাজ করছে। যিনি এর জনক, যার এই স্বপ্নের ভুবন, আজ তিনি নেই। প্রায় তিন বছর হতে যাচ্ছে তিনি তাঁর এই আপন ভুবন ছেড়ে, পৃথিবী ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন। রয়ে গেছে তাঁর সৃষ্টি।

একঝাঁক নিবেদিত প্রাণ তাঁর আদর্শে তাঁর স্বপ্নের এই পত্রিকাটি ভালোবেসে দাঁড় বেয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ৩১ বছর ধরে তার প্রত্যেকটি শাখা-প্রশাখা নিয়ে সদর্পে পথ চলছে ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’। 
জনকণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা আমাদের প্রিয় সম্পাদক স্যার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ- তাঁর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় কোটি মানুষের চোখে বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলেন সে সময়। তাঁর এই সৃষ্টি আজও স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। আজও ‘যাপিত জীবন’ পরিবর্তিত জীবনের পথ চলায় কোটি মানুষের সঙ্গী হয়ে আছে। শুরু থেকে প্রতি সপ্তাহে পাতাটি প্রকাশ পেলেও, কোভিডে সৃষ্টি হওয়া বিরূপ পরিস্থিতির কারণে তা এখন ১৫ দিন পর পর সোমবারে প্রকাশিত হচ্ছে। অগণিত পাঠকের ভালোবাসায় সিক্ত, আমাদের স্যারের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। ভালোবেসেই হাঁটছি আমরা এ পথ।

×