ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

মুসলিমদের কাছে জমজম কূপের পানি কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ ?

প্রকাশিত: ০১:৩১, ৫ জুন ২০২৫

মুসলিমদের কাছে জমজম কূপের পানি কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ ?

ছবিঃ সংগৃহীত

সারা বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানের কাছে জমজম কূপের পানি শুধুমাত্র এক ধরনের বিশুদ্ধ পানি নয়, বরং এটি বিশ্বাস, আশ্রয় ও অলৌকিকতার প্রতীক। সৌদি আরবের পবিত্র নগরী মক্কায় মসজিদুল হারামের অভ্যন্তরে অবস্থিত এই কূপ কাবা ঘরের মাত্র ২০ মিটার দূরে অবস্থিত, যা মুসলিমদের নিকট বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

হজ ও ওমরাহ পালন করতে যাওয়া লক্ষ লক্ষ মুসলমান প্রতিবছর এই পবিত্র পানি সংগ্রহ করেন এবং নিজ নিজ দেশে ফিরলে তা আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিতরণ করেন। তাদের বিশ্বাস—জমজমের পানি পান করলে রোগ, বিপদ কিংবা অশুভ কিছু থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

জমজম কূপের উৎপত্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইসলাম ধর্মের অন্যতম মহান নবী ইব্রাহিম (আ.) ও তার স্ত্রী হাজেরা (আ.) এবং শিশু ইসমাইল (আ.)-এর স্মরণীয় ঘটনা। মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআনের সুরা ইব্রাহিম ও বিভিন্ন হাদিসগ্রন্থে এই কাহিনির বিশদ বর্ণনা রয়েছে।

বিশ্বখ্যাত হাদিস সংকলন সহিহ আল-বুখারি-তে ইমাম বুখারি (রহ.) আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর সূত্র ধরে লেখেন, আল্লাহর আদেশে নবী ইব্রাহিম (আ.) তার স্ত্রী হাজেরা ও শিশু পুত্র ইসমাইলকে নির্জন, জনমানবহীন মরুভূমিতে—আজকের মক্কা শহরের কাবা ঘরের নিকটস্থ স্থানে রেখে যান। তাদের সঙ্গে ছিল কিছু খাবার ও পানি।

খাবার ও পানি শেষ হয়ে গেলে, শিশুপুত্র ইসমাইল তৃষ্ণায় কাঁদতে শুরু করে। তখন মা হাজেরা (আ.) পানি খুঁজতে মরিয়া হয়ে দুই পাহাড়—সাফা ও মারওয়ার মাঝে সাতবার দৌড়ান। ইসলামের আরেক মহান সূত্র অনুযায়ী, এই ঘটনাই সাঈ (সাফা-মারওয়া দৌড়) নামে হজ ও ওমরাহর অংশ হিসেবে মুসলমানরা পালন করেন।

অলৌকিক উত্সের আবির্ভাব

সহিহ বুখারির বর্ণনা অনুযায়ী, মারওয়া পাহাড়ের কাছে হাজেরা (আ.) একজন ফেরেশতা—জিবরাইল (আ.)-কে দেখতে পান। ফেরেশতা তখন পায়ের গোড়ালি দিয়ে মাটিতে আঘাত করলে সেখানে থেকে ঝর্ণার মতো পানি বেরিয়ে আসে—যা আজকের জমজম কূপ হিসেবে পরিচিত।

ইসলামি ঐতিহাসিক ও পণ্ডিত ইমাম ইবনে জারির আল-তাবারিও তার ‘তারিখু তাবারি’ গ্রন্থে জমজম কূপের বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লেখেন, ইসমাইল (আ.) পায়ের আঘাতে মাটি সরিয়ে ফেললে আল্লাহর রহমতে পানি বেরিয়ে আসে। এরপর হাজেরা (আ.) তাড়াতাড়ি বালি ও পাথরের সাহায্যে ওই স্থান ঘিরে রাখেন যাতে পানি থেমে না যায়।

এই কূপের পানি শুধুমাত্র ইসমাইল ও হাজেরার জীবন বাঁচায়নি, বরং মুসলিম ইতিহাসে তা হয়ে ওঠে বিশ্বাস ও আল্লাহর কুদরতের এক জ্বলন্ত নিদর্শন। আজও এই পানিকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি মুসলমানের মাঝে এক আত্মিক বন্ধন ও আধ্যাত্মিক অনুভূতি বিরাজ করে।

বিশ্বাসের ধারাবাহিকতা

আজও হজ বা ওমরাহ পালন শেষে মুসলমানরা জমজম কূপের পানি সঙ্গে করে দেশে নিয়ে আসেন। অনেকে একে ওষুধ বা বরকতময় পানি হিসেবে ব্যবহার করেন। দীর্ঘদিন পাত্রে রাখলেও এই পানি সহজে নষ্ট হয় না—এটিকেও অনেক মুসলমান অলৌকিকতা বলে বিবেচনা করেন।

জমজম কূপ তাই কেবল একটি পানির উৎস নয়—এটি মুসলিম ইতিহাস, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির এক মহার্ঘ নিদর্শন।

আলীম

×