ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৩ মে ২০২৫, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

হরিণ কোরবানি কি জায়েজ?

প্রকাশিত: ১০:০৪, ২৩ মে ২০২৫

হরিণ কোরবানি কি জায়েজ?

বিশেষজ্ঞদের মতে, হালাল হলেও কোরবানির উপযুক্ত নয় হরিণ; কোরআন ও হাদিসের আলোকে বিশ্লেষণ-

ইসলামে কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা নির্দিষ্ট চতুষ্পদ গৃহপালিত পশুর মাধ্যমে আদায় করা হয়। তবে প্রশ্ন জাগে, হরিণ (ডিয়ার) কোরবানি করা কি শরিয়তসম্মত? অনেকেই কৌতূহল থেকে এ বিষয়ে জানতে চান। ইসলামি ফিকহ ও দলিলনির্ভর উৎস বিশ্লেষণে দেখা যায়, হরিণ কোরবানির জন্য উপযুক্ত নয়।

কোরবানির পশু নির্ধারিত 
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কোরবানির নিয়ম করেছি, যাতে তারা নির্দিষ্ট গৃহপালিত পশুদের উপর আল্লাহর নাম স্মরণ করে কোরবানি করে...। (সুরা হজ: ৩৪)

আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং কোরবানির উট (البدن) আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনরূপে করেছি...।’ (সুরা হজ: ৩৬)

তাফসিরে ইবনে কাসির, তাফসিরে কুরতুবিসহ বহু তাফসিরকার একমত যে—এখানে “بهيمة الأنعام” বলতে বোঝানো হয়েছে, গরু, ছাগল, ভেড়া, উট। এগুলোই কোরবানির জন্য নির্ধারিত চতুষ্পদ গৃহপালিত পশু। হরিণ এই তালিকায় পড়ে না।

হাদিসেও গৃহপালিত পশুই নির্দিষ্ট
রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘যখন তোমরা কোরবানি করো, তখন তা গৃহপালিত পশু দ্বারা করো।’ (সুনানে আবু দাউদ: ২৭৯০, হাদিসটি হাসান)

কেউ যদি কোনো হরিণের বাচ্চা ছোটবেলা থেকে গৃহপালিত পশুর মতো পালতে থাকে, তবু তা দ্বারা কোরবানি হবে না। কারণ স্বভাবত এরা গৃহপালিত নয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে- বন্য প্রাণী কোরবানি করার কোনো প্রমাণ রাসুল (স.) থেকে প্রমাণিত নয়। তাই কোরআন-হাদিসে নির্ধারণ করে দেওয়া পশুগুলো ছাড়া অন্যান্য যেকোনো পশু যেমন হরিণ, বন্য গরু ইত্যাদি দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ নয়। (কাজিখান: ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৫)

চার মাজহাবের ইজমা: হরিণ কোরবানিযোগ্য নয়
চার মাজহাবের ইমামগণ (আবু হানিফা, মালেক, শাফেয়ে, আহমদ) একমত যে, ‘কোরবানি কেবল উট, গরু, ছাগল ও ভেড়া দ্বারা বৈধ; অন্য কোনো প্রাণী দ্বারা নয়।’

দলিল
আল-মাজমু (ইমাম নববি)
আল-মুগনি (ইবনে কুদামা)
ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া
হাশিয়াতু ইবনে আবেদিন

তবে মহিষ কোরবানির উপযুক্ত পশু; এ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই। সুরা হজ্জের ৩৪ ও ৩৬ নং আয়াতে البدن ও الأنعام শব্দদ্বয় উল্লিখিত হয়েছে, যা উট, গরু বা গরু জাতীয় পশুকে বুঝায়। আর মহিষ ও গরু যে একই জাতীয় পশু। তাই মহিষ কোরবানি দেওয়াতে কোনো দোষ নেই। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ১০৮৪৮; মিরআত: ৫/৮১; মাজমু ফতোয়া ওসাইমিন: ২৫/৩৪)

হরিণ হালাল কিন্তু কোরবানিযোগ্য নয়
হরিণ খাওয়া হালাল—এই বিষয়ে শরিয়তের অনুমোদন আছে। কোরআনে এসেছে, ‘সমুদ্রের শিকার ও তার খাদ্য তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে... এবং স্থল শিকারও হালাল (হজের বাইরে)।’ (সুরা মায়িদা: ৯৬)

তবে এই ‘শিকারযোগ্য বন্য প্রাণী’ (যেমন হরিণ, হরিণজাতীয় গ্যাজেল ইত্যাদি) কোরবানির পশু নয়।

সাহাবিদের মতামত
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘কোরবানির পশু কেবল গৃহপালিত চতুষ্পদ জীব হতে হবে। বন্য শিকার কোরবানির জন্য নয়।’ (দারাকুতনি, আছার সংকলন)

ইসলামি স্কলারদের বক্তব্য
মুফতি তাকি উসমানি (দা.বা.) বলেন, ‘কোরবানির জন্য কেবল গৃহপালিত পশুই গ্রহণযোগ্য। হরিণ, খরগোশ, ঘোড়া ইত্যাদি কোরবানিযোগ্য নয়, যদিও তা হালাল শিকার হতে পারে।’ (ফিকহুল বুয়ূ, খণ্ড ৩)

শেষ কথা, হরিণ হালাল প্রাণী হলেও কোরবানির জন্য জায়েজ নয়। কোরবানি কেবল গৃহপালিত পশু—উট, গরু (মহিষ), ছাগল ও ভেড়া দ্বারা আদায় করতে হবে। ইসলামি শরিয়তে এর বাইরে কোনো ব্যতিক্রম নেই। যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হরিণ কোরবানি করেন, তা শরিয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হবে না এবং তা দ্বারা কোরবানির ফরজ আদায় হবে না।

তথ্যসূত্র:
কোরআন মাজিদ: সুরা হজ ৩৪, ৩৬; সুরা মায়িদা: ৯৬
হাদিস: সুনান আবু দাউদ ২৭৯০
ফিকহ গ্রন্থ: আল-মাজমু’, আল-মুগনি, ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া, হাশিয়াতু ইবনে আবেদিন
সমকালীন স্কলার: মুফতি তাকি উসমানি, ফিকহুল বুয়ু

সজিব

×