ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

নৌকার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়ন বঞ্চিত নেতারা

প্রকাশিত: ০০:৪৯, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩

নৌকার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী  মনোনয়ন বঞ্চিত নেতারা

.

সুন্দরবনের কোলঘেঁষা কালীগঙ্গা, বলেশ্বর, দামোদর, সন্ধ্যাবিধৌত প্রাকৃতিক সবুজের লীলাভূমি পিরোজপুর জেলা। বৈচিত্র্যে ভরপুর পিরোজপুর জেলায় তিনটি সংসদীয় আসন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রার্থীদের প্রচারে জমজমাট হয়ে উঠেছে পিরোজপুর। জানুয়ারির নির্বাচন সামনে রেখে চলছে চায়ের আড্ডা, গ্রামে-গঞ্জে, শহর-বন্দরে নির্বাচনী অফিস নির্মাণ, ওয়ার্ড-পৌরসভা-ইউনিয়নভিত্তিক নির্বাচনী পরিচালনা কমিটি গঠন এবং প্রার্থীদের সঙ্গে চলছে মতবিনিময়। তিনটি আসনে নৌকার মাঝিরা হলেনÑ পিরোজপুর- আসনে মৎস্য প্রাণিসম্পদমন্ত্রী রেজাউল করিম, পিরোজপুর- আসনে কানাই লাল বিশ^াস, পিরোজপুর- আসনে আশরাফুর রহমান। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ে তিনটি আসনে ১০ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। বর্তমানে তিনটি আসনে প্রার্থী রয়েছেন ২৩ জন। পিরোজপুর- আসনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। পিরোজপুর- আসনে জাতীয় পার্টির (জাপা) মনোনয়নবঞ্চিত বর্তমান এমপি ডা. রুস্তম আলী ফরাজী স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।

পিরোজপুর- পিরোজপুর সদর-নাজিরপুর-ইন্দুরকানী এই তিন উপজেলা নিয়ে গঠিত পিরোজপুর- আসন। আসনটিতে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন নয় প্রার্র্থী। যাচাই-বাছাইয়ে চারজনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। বৈধ প্রার্থীরা হলেনÑ মন্ত্রী রেজাউল করিম (আওয়ামী লীগ), একেএমএ আউয়াল (স্বতন্ত্র), মো. নজরুল ইসলাম (জাতীয় পার্টি), মো. সাইদুল ইসলাম ডালিম (জাসদ) এবং মো. ফরহাদ আহম্মেদ (জাকের পার্টি) নির্বাচনী আসন পুনর্বিন্যাসের কারণে প্রার্থীরা কিছুটা বিপাকে পড়লেও পিছিয়ে নেই নির্বাচনী প্রচার। এলাকাগুলোতে এখন ভোটারদের মাঝে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। মৎস্য প্রাণিসম্পদমন্ত্রী রেজাউল করিম এই আসনে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান এবং বিপুল ভোটের ব্যবধানে সাঈদীপুত্র শামীম সাঈদীকে পরাজিত করে এমপি হন এবং তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। এবারও রেজাউল করিম আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ায় আসনের শান্তিপ্রিয় জনগণ উল্লাস প্রকাশ করে এবং তার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। গত পাঁচ বছরে এলাকার গ্রামীণ রাস্তা সংস্কার, সম্প্রসারণ মজবুতকরণ, ব্রিজ-কালভার্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মন্দির-মসজিদের অবকাঠামগত উন্নয়ন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ, অসহায় মানুষকে সরকারি উদ্যোগে ঘর করে দেওয়া, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিভিন্ন পর্যায়ে ভাতা প্রদান করা, শতভাগ বিদ্যুতায়িত করাসহ অসংখ্য উন্নয়নে পিরোজপুর- আসনের অধিবাসীরা শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ এবং খুশি। ছাড়া পিরোজপুরে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার-সন্ত্রাস বন্ধ করে শান্তির জনপদে পরিণত করেছেন পিরোজপুর- আসনের এমপি রেজাউল করিম।

ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান এমপি এলাকায় উন্নয়ন চাঁদাবাজি বন্ধ করায় তার প্রতি খুশি তারা। যিনি উন্নয়ন করতে পারবেন, সেই প্রার্থীকেই তারা ভোট দেবেন। যারা ১০ বছর এমপি হয়েও তেমন কোনো কাজ করেননি সাধারণ মানুষেকে হামলা-মামলা জেল-জুলুম, অত্যাচার নির্যাতন করেছে তাদের ভোট দেবেন না।

আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মন্ত্রী রেজাউল করিম বলেন, পিরোজপুর- আসনে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনসহ অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে। চাঁদাবাজি বন্ধ করা, ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত করা, নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধ করা, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কমিশন নেওয়া বন্ধ করা, সন্ত্রাস বন্ধ করা, মাদকের ছোবল থেকে রক্ষা করাসহ নানামুখী কর্মসূচির মাধ্যমে শান্তি উন্নয়নের জনপদে পরিণত করেছি পিরোজপুরকে। সঙ্গত কারণেই মানুষ চায় এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে শেখ হাসিনার মনোনীত প্রার্থীকে ভোট দিতে। স্বতন্ত্র প্রার্থী একেএমএ আউয়াল তার ভাই এবং তাদের অনুগত কিছু কর্মী, নৌকার কর্মী-সমর্থকদের জীবননাশের হুমকি দিয়ে নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। তাদের সন্ত্রাসী বাহিনীর নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা জনগণ রুখে দেবে। তবে আইনের কঠোর প্রয়োগ আশা করি। স্বতন্ত্র প্রার্থী একেএমএ আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, দুইবার এমপি ছিলাম, মানুষের জন্য কাজ করেছি। মানুষের চাওয়া সেজন্য আমি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি। আওয়ামী লীগ সভাপতি স্বতন্ত্র করার সুযোগ দিয়েছে, তাই নির্বাচন করছি। জেলা মৎস্যজীবী লীগের আহ্বায়ক সিকদার চাঁন বলেছেন, আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে আওয়ামী লীগ তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে যেতে পারছেন না। স্বতন্ত্র প্রার্থী একেএমএ আউয়ালের পক্ষে সেখানে নির্বাচন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে দুঃসময়ের নেতাকর্মীদের কমিটিতে না রেখে এই স্বতন্ত্র প্রার্থী তার ব্যক্তিগত লোকজন দিয়ে কমিটি করেছেন।

পিরোজপুর- ভা-ারিয়া-কাউখালী-নেছারাবাদ এই তিনটি উপজেলা নিয়ে গঠিত পিরোজপুর- আসন। আসনটিতে মোট ১০ প্রার্র্থী মনোনয়পত্র দাখিল করেন। যাচাই-বাছাইয়ে একজনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। বৈধ প্রার্থীরা হলেনÑ আনোয়ার হোসেন মঞ্জু (জেপি), কানাই লাল বিশ্বা (আওয়ামী লীগ), মো. মহিউদ্দিন মহারাজ (স্বতন্ত্র), মো. জাকির হোছাইন (বিটিএফ), মো. মাহতাব উদ্দিন মাহমুদ (গণফ্রন্ট), মো. মিজানুর রহমান (বিএসপি), মো. আবুল বাশার (এনপিপি), মো. ছগির মিয়া (বাংলাদেশ কংগ্রেস), মো. ফয়সাল (জাকের পার্টি) আসনে স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এমপি নির্বাচিত হন। বর্তমান এমপি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু জাতীয় পার্টি জোট-মহাজোট থেকে সাতবার এমপি নির্বাচিত হয়ে আসনটি দখল করে রাখেন। বর্তমানে আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে কানাই লাল বিশ্বা মনোনয়ন পায়েছেন। জানা গেছে, জেপি থেকে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে ১৪ দলের শরিক দল হিসেবে নৌকা প্রতীকের জন্য জেপি চেয়ারম্যান পত্র দিয়েছেন।

আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর আসনে দীর্ঘদিন পর হলেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দখলে চলে আসে। অনেকে জেপি থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন মহারাজ স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় আসনের তিন উপজেলার ৯৫ ভাগ জনপ্রতিনিধি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মহিউদ্দিন মহারাজের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিচ্ছেন। ভান্ডারিয়ায় পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার প্রার্থী মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় জেপির দুর্গে ভাঙন ধরে। তবে তিন উপজেলায় নৌকার প্রার্থী কে হয়ে আসছেন, তা নিয়ে ভোটারদের মাঝে চলছে নানা গুঞ্জন। ভোটারদের দাবি, জেপির মঞ্জু নৌকা মার্কার প্রার্থী হলে এবার তারা মহিউদ্দিন মহারাজকে বেছে নেবেন। ভা-ারিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান মিরাজুল ইসলাম বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আসনে একটি শক্তিশালী দল। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর জেপি অত্যাচার, নির্যাতন করেছে। বারবার নির্বাচনে জোটের প্রার্থী থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নেতাকর্মীরা। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু নৌকা প্রতীক পেলেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী জনপ্রতিনিধিরা মেনে নেবেন না।

পিরোজপুর- মঠবাড়িয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত পিরোজপুর- আসন। পিরোজপুর- আসনে মোট ১৪ প্রার্র্থী মনোনয়পত্র দাখিল করেন। যাচাই-বাছাইয়ে পাঁচজনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। বৈধ প্রার্থীরা হলেনÑ মো. রুস্তম আলী ফরাজী (স্বতন্ত্র), মো. আশরাফুর রহমান (আওয়ামী লীগ), মো. মাশরেকুল আজম রবি (জাতীয় পার্টি), চন্দ্র শেখর ওঝা (জাকের পার্টি), মো. আমির হোসেন (এনপিপি), মো. জাসেম মিয়া (মুক্তিজোট), মো. শামীম শাহনেওয়াজ (স্বতন্ত্র), মো. শহিদুল ইসলাম স্বপন (বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি), হোসাইন মোসারেফ সাকু (বাংলাদেশ কংগ্রেস) বর্তমান এমপি রুস্তম আলী ফরাজী জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন মাশরেকুল আজম রবি।

তিনি জিএম কাদেরের উপদেষ্টা হওয়ায় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে আসনে আওয়ামী লীগ নেতৃতাধীন মহাজোটের শরিক দলের প্রার্থী রুস্তম আলী ফরাজীকে আসনটি ছেড়ে দেওয়ায় তিনি লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেন। এবার মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী রুস্তম ফরাজীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আশরাফুর রহমানের সঙ্গে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা হবে।

×