
দেশে ভূমিসেবা এখন আগের চেয়ে অনেক সহজ এবং আধুনিক হয়েছে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবোত্তর নতুর বাংলাদেশে সরকার ভূমি ব্যবস্থাপনাকে আরও স্বচ্ছ, দ্রুত ও জনবান্ধব করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ভূমি ব্যবস্থাপনায় অমূল পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়। ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পূর্বে প্রায় তিন বছর আওয়ামী ফ্যাসিবাদি সরকার ভূমি ব্যবস্থাপনার মৌলিক সেবার জন্য ক্রয়কৃত সফটওয়্যারগুলো আপডেটের কথা বলে কালক্ষেপণ করেছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয় এবং জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের ১ তারিখ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত (লইভ) করে। গণ-অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে এদেশের ইন্টারনেট সেবা প্রদান সংক্রান্ত দপ্তরগুলোতে বেশকিছু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে এবং ফ্যাসিস্ট সরকারের চক্রান্তে কৃত্তিমভাবে প্রস্তুত একটি বন্ধুর পথ অতিক্রম করে আজ এক বছর পর বাংলাদেশ আবার ঘুরে দাঁড়াতে প্রস্তুত।
ভূমি সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সঠিক ভূমি ব্যবস্থাপনা সমগ্র অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে পারে। বাংলাদেশের মতো গ্রাম প্রধান দেশে ভূমি সংস্কারের গুরুত্ব আরও বেশি। দেশের জনগণ তাদের আদি নিবাস, বংশমর্যাদা, অতীত ঐতিহ্য ইত্যাদি প্রকাশের জন্য ভূমির মালিকানা নিশ্চিত করতে চায়। বর্তমান সরকার নাগরিকবান্ধব, জনগণের জীবন-যাত্রাকে আরও সহজ ও আধুনিক করার লক্ষ্যে এক বছর ধরে ভূমি মন্ত্রণালয় ঢাকা, সিলেট, ফরিদপুর, হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার সাধারণ মানুষের সঙ্গে স্টেকহোল্ডার কনসালট্যাশন সভার আয়োজন করে। এসব সভায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, আইনজীবী, শ্রমিক, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিসহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাগণ মতবিনিময় করেন। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে আমরা ভূমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যথাযথ সংস্কারের প্রস্তাব প্রেরণ করেছি। আমরা আশা করি, ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে ভূমির মালিকানা কাঠামোকে আরও স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং সমতাভিত্তিক করা সম্ভব হবে, যা দেশের নিম্নআয়ের মানুষ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য নবদিগন্ত উন্মোচনে সহায়ক হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে ভূমি সংস্কারের ইতিহাস বহু পুরানো হলেও তা পর্যাপ্তভাবে কখনই কার্যকর হয়নি। একটি কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও একদিকে বৃহৎ জমিদারি ব্যবস্থা ও অন্যদিকে ভূমির মালিকানা সম্পর্কের জটিলতা কৃষকদের সার্বিক উন্নতি অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করেছে যুগ যুগ ধরে। রাষ্ট্রীয় সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে ভূমির অসম বণ্টন এবং বিতরণে বৈষম্য একটি বড় সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে অধিকাংশ কৃষক ভূমি কম থাকায় লাভজনকভাবে চাষাবাদ করতে পারেননি। এ কারণে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষকের আয় বৃদ্ধি এবং সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। বিগত সময়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদি শাসনকালে সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তারা ধ্বংস করেছে। ভূমি মন্ত্রণালয়েও এর প্রভাব দৃশ্যমান। দীর্ঘদিনের সমস্যা একদিনে বা রাতারাতি সমাধান সম্ভব নয়। তবে আমাদের তরফ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটি বিষয় আমলে নিয়ে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সরকারের কাছে আমাদের প্রেরিত সংস্কার প্রস্তাব গৃহীত হলে এবং তা যদি চলমান থাকে তাহলে ভূমি ব্যবস্থাপনায় যুগান্তকারী পরিবর্তন সম্ভব। প্রথমত, ভূমির পুনর্বণ্টন ও কৃষকদের মধ্যে ভূমির মালিকানা সমভাবে ভাগ করে দেওয়ার মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বাড়ানো। ফলে প্রান্তিক কৃষকদের কাছে জমি পৌঁছাবে, যারা নিজেদের চাষাবাদে বেশি মনোযোগী হতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, এটি দেশে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি, ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে। তৃতীয়ত, কৃষকের আয়ের উন্নতি, তাদের জীবনমানের উন্নতি এবং গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। এছাড়া ভূমির অবৈধ দখল ও জমির কালোবাজারি বন্ধ করা সম্ভব হবে, যা দেশের উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত ছিল বিগত সময়ে। কিন্তু তা প্রতিকারের কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ভূমি সংস্কার বাস্তবায়ন খুব সহজ নয়। একদিকে বৃহৎ জমির মালিকরা সাধারণত ভূমি সংস্কারের বিরোধিতা করেন, কারণ তারা নিজেদের জমির মালিকানা হারানোর ঝুঁকি অনুভব করেন। অন্যদিকে দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা ভূমি সংস্কারের কার্যকর বাস্তবায়নকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করে। ভূমির সঠিক পরিমাপ, সুষ্ঠু বণ্টন এবং তার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে সঠিক তদারকি নিশ্চিত করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা চাই, ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে সর্বপ্রথম দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে, যেন গ্রামীণ অর্থনীতি ও সাধারণ কৃষকের আয় বৃদ্ধি পায়। এজন্য আমরা পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের শক্তিশালী রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং কার্যকর পরিকল্পনা আশা করি। ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে এ দেশের সাধারণ মানুষ ও অর্থনীতির জন্য একটি বড় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনাকে আরও গতিশীল করতে ইতোমধ্যেই জমির অনলাইন রেকর্ড কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে, জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (GIS) ম্যাপিংয়ের কাজ দ্রুতগতিতে চলমান রয়েছে এবং আগামী অর্থবছর থেকে ভূমি ব্যবস্থাপনা সফটওয়ারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) সংযোজনেরও পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয় তথা সরকার কর্তৃক গৃহীত এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে দ্রুত ভূমি কেন্দ্রিক দুর্নীতি, সেবা প্রক্রিয়ার ধীরগতি, সাধারণ জনগণের হয়রানি ও ভোগান্তি কমিয়ে ভূমিসেবাকে আরও গতিশীল এবং কার্যকর করা যাবে। ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে জনবান্ধব ভূমিসেবার নবদিগন্ত দ্বার উন্মোচিত হবে, এমন প্রত্যাশা আমাদের সবার।
লেখক : সিনিয়র সচিব, ভূমি মন্ত্রণালয় ও
বিশেষ কর্মসূচি কনসালট্যান্ট, ভূমি মন্ত্রণালয়
প্যানেল/মো.