
বর্তমানে বাংলাদেশের বেশিরভাগ তরুণ-তরুণী নীরব মানসিক স্বাস্থ্য সংকটে ভুগছেন। প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা, বেকারত্ব, সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তি, পারিবারিক চাপসহ নানা কারণে তারা হতাশায় জীবন অতিবাহিত করছেন। অধিকাংশ সময় এই মানসিক সংকটের চূড়ান্ত পরিণতি হয় আত্মহত্যা, মাদকাসক্তি বা। কিন্তু এই তরুণরাই আগমীর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। তাই এ সংকটের কারণ ও সমাধান চিহ্নিত করে তার সমাধান বের করা সময়ের দাবি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মতে, বাংলাদেশের ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে প্রায় ১৭% কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। অথচ দেশে প্রতি ৩ লাখ মানুষের জন্য মাত্র ১ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যুরো অফ স্ট্যাটিস্টিকস (ইইঝ)-এর তথ্যমতে, দেশের তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ১৩%। ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ৪৫% বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মাঝারি বা তীব্র মানসিক উদ্বেগে ভোগেন। ২০২৩ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে, যাদের মধ্যে একজন নিজের চূড়ান্ত সেমিস্টারের ফলাফল নিয়ে গভীর হতাশায় ছিল। এগুলো প্রমাণ করে, মানসিক স্বাস্থ্য সেবা ও সচেতনতার ঘাটতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে।
মানসিক চাপের বেশকিছু কারণ রয়েছে। যেমন- কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থা এমন যে, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেও চাকরি পাচ্ছেন না অনেকে। ফলে অনেক তরুণ-তরুণীরা হতাশায় ভেঙ্গে পড়ছেন। কর্মক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের অভাব, বেতন বৈষম্য মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয়। এক গবেষণায় দেখা যায়, উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেকারত্বের হার তুলনামূলকভাবে বেশি। পড়াশোনার চাপ মানসিক সমস্যার বড় একটি কারণ। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন প্রায় পুরোপুরি পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভরশীল। ‘এ+’ কিংবা সিজিপিএ ভালো না হলে অনেক পরিবারেই শিক্ষার্থীরা মূল্যায়িত হন না। এতে করে তাদের আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে, হতাশা জন্ম নেয়। ফলে শিক্ষার্থীরা মানসিক সংকটে ভোগেন।
বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেতিবাচক প্রভাব লক্ষণীয়ভাবে দেখা যাচ্ছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক প্রভৃতি প্ল্যাটফর্মে অন্যদের ‘আদর্শ জীবন’ দেখে নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করা, ঋঙগঙ (ঋবধৎ ড়ভ গরংংরহম ঙঁঃ)-এ ভোগা এবং সাইবার বুলিং তরুণদের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। এছাড়া, সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার ঘুমের সমস্যা, মনোযোগের অভাব এবং উদ্বেগ বাড়ায়। ফলে মানসিক সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে। পারিবারিক চাপ ও সমাজের মনোভাব মানসিক সমস্যা আরেকটি বড় কারণ হতে পারে। বাংলাদেশি পরিবারে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক আলোচনা প্রায় নিষিদ্ধ। ছেলে মানসিকভাবে দুর্বল হলে তাকে ‘নরম’ বলা হয়। আর মেয়েরা এমন কিছু বললে তা ‘অভিনয়’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। এই মনোভাব তরুণ-তরুণীদের নিঃসঙ্গ করে তোলে। নানা ভ্রান্ত ধারণাও অনেক সময় তরুণদের সমস্যা প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশে মানসিক রোগ চিকিৎসায় অভিজ্ঞ চিকিৎসক, কাউন্সেলর ও সেবার অভাব রয়েছে। শহরের বাইরে এসব সেবা প্রায় নেই বললেই চলে। স্কুল-কলেজেও নেই কোনো স্থায়ী কাউন্সেলিং ব্যবস্থা। যদিও থাকে তবে তা নিষ্ক্রিয় বলা যায়। গ্রামীণ এলাকায় এই সেবা প্রায় অদৃশ্য। তরুণদের মানসিক সমস্যাকে অবহেলা করার পরিণতি মারাত্মক হতে পারে। হতাশা থেকে জন্ম নেয় আত্মহত্যা, মাদকাসক্তি, সম্পর্ক ভাঙন এবং কর্মক্ষেত্রে ব্যর্থতা। এককভাবে তা ব্যক্তিগত সমস্যা মনে হলেও সামষ্টিকভাবে তা জাতীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একটি হতাশাগ্রস্ত তরুণ প্রজন্ম মানে হলো কম উৎপাদনশীলতা, কম উদ্ভাবন এবং কম নেতৃত্ব। যা বাংলাদেশকে এক ধাপ পিছিয়ে দিতে পারে।
এই সমস্যা দেখেও কি আমরা চুপ থাকব! না আমাদের সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ করতে হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপন, টেলি-কাউন্সেলিং সার্ভিস চালু করে শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ জনগণকেও সেবা দিতে হবে। সরকারি হাসপাতালে মনোরোগ বিভাগ শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের শুধু পরীক্ষাভিত্তিক নয়, ব্যক্তিত্ব ও মানসিক দক্ষতা বিকাশমূলক শিক্ষা চালু করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমাতে পরীক্ষা ব্যবস্থায় নমনীয়তা আনা দরকার। শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যেন তারা মানসিক সমস্যাকে গুরুত্ব দেন। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্তত একজন প্রশিক্ষিত কাউন্সেলর নিয়োগ দেওয়া উচিত যেন শিক্ষার্থীরা নিরাপদে তাদের সমস্যার কথা ভালোভাবে বলতে পারেন। ছাত্রছাত্রীদের মাঝে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলা আলোচনা উৎসাহিত করতে হবে। গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রচার চালাতে হবে। স্কুল-কলেজে নিয়মিত সেমিনার ও ওয়ার্কশপ আয়োজন করতে হবে। ধর্মীয় নেতারাও যদি এই বিষয়ে কথা বলেন, তা হলে সমাজে ইতিবাচক বার্তা পৌঁছাবে। সেইসঙ্গে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে তরুণদের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর ও কর্মমুখী প্রশিক্ষণ চালু করতে হবে, যেন তারা আত্মনির্ভরশীল হয়ে মানসিক চাপ কমাতে পারে। উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য তরুণদের সহযোগিতা ও আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে। তাহলে তরুণরা মানসিক চাপ থেকে অনেকটা মুক্তি পাবে।
দেশের তরুণরাই আগামী দিনের নেতা, উদ্যোক্তা ও পথপ্রদর্শক। তাই তাদের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব। মানসিক স্বাস্থ্যকে যেন আর ছোট করে না দেখে, গুরুত্বের সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা আবশ্যক। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র একত্রে কাজ করলে আমরা এক নতুন, সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারি। মানসিক স্বাস্থ্য বিলাসিতা নয়। এটি মৌলিক অধিকার। আলোকিত ভবিষ্যতের জন্য তরুণদের আলোকিত মন প্রয়োজন।
লেখক : সাংবাদিক
প্যানেল