ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২

রোল নম্বর: জীবনের মানদণ্ড নয়

সাফিয়া নূর মোকাররমা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিসিন অনুষদ, ফিজিওথেরাপি বিভাগ

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ১৭ জুন ২০২৫; আপডেট: ১০:৫৭, ১৭ জুন ২০২৫

রোল নম্বর: জীবনের মানদণ্ড নয়

ছবিঃ সংগৃহীত

একটি কচি চারাগাছ যেমন সদা শঙ্কিত—কখন যেন কারও পায়ের নিচে পিষ্ট হয়, কখন ঝড় এসে ভেঙে দেয় তার স্বপ্নপল্লব—তেমনি এক অজানা আতঙ্কে দিন কাটে একটি কোমল শিশুমনের, যে সদ্য বিদ্যালয়জগতে পা রেখেছে।

আমার জীবনেও ছিল এক এমন অধ্যায়, যেখানে রোল নম্বরই হয়ে উঠেছিল আমার একমাত্র পরিচয়। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক—সবখানে 'তিনের মধ্যে' থাকার এক অদৃশ্য শেকল যেন বেঁধে রেখেছিল আমাকে। একবার রোল নম্বর ‘পাঁচ’ হয়ে গিয়েছিল। বিদায় অনুষ্ঠানে প্রকাশিত তালিকায় নামটা একটু নিচে দেখে মনে হয়েছিল—এই তো শেষ! হয়তো আর কিছুই হবে না আমার জীবন থেকে।

চারপাশের মানুষ যেন এক অদৃশ্য কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিত—শুধু একটি সংখ্যার ভিত্তিতে। আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে পাড়ার চেনা মুখগুলো—প্রথমেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিত, “রোল কত?” আর উত্তর যদি হতো ‘পাঁচ’, তবে ভ্রু কুঁচকে কটাক্ষ, দীর্ঘশ্বাসে হতাশা, কিংবা উপহাসে ঝরা পাতার মতো ঝরে পড়ত আমার আত্মবিশ্বাস।

সেই বয়সে বুঝিনি—একটা ছোট্ট সংখ্যা কীভাবে হৃদয়ের ভিতরে এমন দীর্ঘ এক ক্ষতের জন্ম দিতে পারে। চোখের জলে ভিজত বালিশ, হাসিমুখের আড়ালে চাপা থাকত অসীম হাহাকার। কখনো কখনো মনে হতো—নিজেকেই যেন মুছে ফেলি এই পৃথিবীর বুক থেকে…কিন্তু সময় তো থেমে থাকে না।

একদিন বুঝলাম—স্কুলজীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল নিজেকে না দেখে, অন্যের চোখে নিজেকে মূল্যায়ন করা। একটি রোল নম্বর কখনোই মানুষের সামগ্রিকতা নির্ধারণ করতে পারে না। সেটা শুধু একটি কাগজের জায়গা—কিন্তু জীবনের মঞ্চে আমাদের অবস্থান গড়ে উঠে সততা, চেষ্টা আর মনুষ্যত্ব দিয়ে।

আজ ফিরে তাকিয়ে দেখি—সেই ‘পাঁচ নম্বর রোল’ই ছিল আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। সেটিই আমাকে শিখিয়েছে সহ্য করতে, সংগ্রাম করতে, নতুন করে গড়ে উঠতে।

আজ আমি বলি—রোল নম্বর নয়, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রোল হলো—একজন পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠা।

নোভা

×